পূর্ব প্রকাশিতের পর,
প্রথমতঃ, সাম্রাজ্যবাদী শোষকরা রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা দু’টোকেই পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক শোষণের কাজে লাগায়৷ প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে বাঙলার ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগ শুরু হয়েছিল মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই৷ আইন-ই-আকবরীতে উল্লেখ আছে যে, বিশাল মোগল-বাহিনীকেই রসদ যোগাত বাঙলা৷ আবার, মোগল যুগের অবসান ঘটতেই চলে এল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যুগও৷
সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পরিপূরক হচ্ছে রাজনৈতিক শোষণ৷ আবার,বাঙলার বুকে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগটা ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের যুগ৷ সেই শোষণের শুরুতে ছিল খোলাখুলি লুটতরাজেরই যুগ৷ সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী শোষণেরই আরেক ধাপ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শোষন যার সহায়ক হচ্ছে উক্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ৷ আবার, শোষণের তৃতীয় ধাপটি হচ্ছে ফ্যাসিষ্ট শোষণ, যেটি শোষণেরই চূড়ান্ত ও ভয়াবহ রূপ৷ (শোষনের বহুবিধরূপ কণিকায় প্রাউট অষ্টাদশ খণ্ড)৷
কারণ, সাম্রাজ্যবাদী শোষকরাই তাদের শোষণ প্রক্রিয়াকে যুক্তি ও তথ্যের ওপর দাঁড় করাবার জন্যে প্রথমেই জাতীয় সমর্থন আদায় করতে সচেষ্ট হয়৷ তাই, ওরা তথ্যরূপে জাতীয়তাবাদের শর্ত আরোপ করে থাকে৷
১৯৪৭ সালের পর থেকে কাগজে কলমে খণ্ডিত ভারতবর্ষ ব্রিটিশশাসনাধীন রইল না৷ কিন্তু, আসলে ভারতবাসীদের রাষ্ট্রিক জীবনে পরিবর্তনটা কী দাঁড়াল? প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা-প্রাপ্তির পর আজ চুয়াত্তর বছর পার হয়ে গেল বাঙলার বিশেষ করে আর ভারতেরও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঔপনিবেশিক শোষণ মুছে যায় নি৷ বরং ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারা সেই শোষণ আরও তীব্র, আরও ব্যাপক ও আরও সুক্ষাতিসূক্ষ্মরূপেই ভারতবাসীদের ওপর চেপে বসেছে৷ উঃ-পূর্ব ভারত সহ পশ্চিমবঙ্গ,ত্রিপুরা, অসম, উড়িষ্যা বিহার ইত্যাদি অঞ্চলসমূহ আজও দেশীয় পুঁজিপতি, শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ী আর তাদেরই দালালদের পুরোপুরি খপ্পরে রয়েছে বলে আর্থিক দিক থেকে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ ভারত-ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা ‘‘ভাগ করো আর শাসন করো’’--- এই নীতি চালু করেছিল একমাত্র বাঙলায়ই৷ আর এ যুগে দেশীয় পুঁজিপতিদের বানানো পুতুল-সরকারগুলো সেই নীতি চালু করে চলছে গোটা ভারতেরই বুকে আর পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চল সমুহকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যেই এন.আর.সি ও সি-এ-এ ইত্যাদি জুজুর ভয় দেখাচ্ছে৷ দেশীয় পুঁজিপতিদের তাঁবেদারি করতেই পেট্রল, ডিজেল. রান্নার গ্যাসসহ, জনসাধারণের নিত্যব্যহার্য ও অপরিহার্য প্রতিটি দ্রব্যের মূলস্তর লাগম হীনভাবেই কর্মবদ্ধমান৷ ইতোমধ্যে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত আর স্বল্প এইচড়া মূল্যস্তরের বাজারে৷ আর এরও একচেটিয়া মুনাফা লুটছে বড় মাপের পুঁজির যোগানদাররা, মজুতদার আর মুনাফাখোররা৷ অপরদিকে নিবু নিবু করেই একের পর এক বাতি নিবে যাচ্ছে ছোট-খাটব্যবসায়ীদের৷ ছোট্ট একটা উদাহরণ দিতে চাইছি পেট্রল-ডিজেলের দামবৃদ্ধির চাক্ষুষ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ৷ চার-পাঁচ বছর আগেও আমাদের এই ত্রিপুরায় কমলপুর থেকে আগরতলার রাসভাড়া ছিল ৩৫ টাকা থেকে ৪০/৪৫ টাকা পর্যন্ত৷ বর্তমানে মোট দাঁড়িয়েছে ৯০টাকা থেকে ১১০টাকা৷ সেই অনুসারে আমার পেনশন বেড়েছে বিগত কয়েক বছরে ৩ শতাংশ৷ শুধু বাসগাড়ীর ভাড়াটাই দেখালুম৷ পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই ওষুধপত্র থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের মূল্যহার বৃদ্ধির সঙ্গে পরিচিত রয়েছেন৷
এবারে আমি আমাদের বেকারত্বের প্রসঙ্গে৷ একটা সুস্থ আর সুষ্ঠু সমাজজীবনে বেকারত্ব নিশ্চয়ই উৎসাহব্যঞ্জক আর প্রশংসারযোগ্য তো হতেই পারে না তবে অবশ্যই আশাব্যঞ্জক আর সমর্থনযোগ্যও নয়৷ কেননা, বেকার যারা তারা তো আমাদেরই সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন--- অন্ততঃপক্ষে আমাদের বৃহত্তর মানবসমাজেরই সদস্য-সদস্যাগণ, তাই না? ভাবুন না একটু ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়েসের একটি বেকার তরুণ বা তরুণীর জীবন যন্ত্রনার দিকটা নিয়ে৷ উক্ত বয়সোত্তীর্ণতরা তাদের জীবনধারাণের প্রয়োজনীয় ‘ফুয়েস’ কোথায় পাচ্ছেন? দ্বিতীয়তঃ আমাদের ত্রিপুরায় বর্তমানে, আটত্রিশ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় আটলাখ তো হবেনই যারা বয়সোত্তীর্ণ আর সদ্য বেকার সবাই মিলে৷ ধরুণ গড়ে যদি প্রত্যেকের মাসিক উপার্জন ১০,০০০ টাকাও ধরা যায় আর এদের সবাই যদি কর্মনিযুক্ত পেয়ে যেতেন তাহলে এ রাজ্যের মাসিক উপার্জনটা গিয়ে দাঁড়াল (৮,০০০০০x ১০০০০= ৮০০০০০০০০০) টাকা অর্থাৎ ৮০০ কোটি টাকা৷ কিন্তু, বাস্তবচিত্রটা হল, ত্রিপুরা রাজ্য এই আয় থেকে সরাসরি সর্বদা বঞ্চিত রয়েছে আর ত্রিপুরার মানুষরাও জাতি-উপজাতি নিবির্শেষে সেই বঞ্চনার জ্বালায় জ্বলে পুড়েই খাক হচ্ছেন৷ তাহলে, এর সমাধানটা কি ‘ত্রিপুরা’ নামের বদলে ‘তিপ্রাল্যাণ্ড’ নাম বানাবার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বলতে চাইছেন? না, কং-এর বদলে রাম আবার বাম-এর বদলে রাম ইত্যাদির মতই রাম পালটিয়ে ‘তৃং’ বা ওই জাতীয় কোন একটা জার্সি বদলালেই হয়ে যাবে বলে ভাবছেন? তাহলেই কি বিনয়-বাদল-দীনেশ, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রীতিলতা, মাষ্টারদা, নেতাজী প্রমুখদের স্বপ্ণে দেখা ভারতবর্ষ ‘‘বনজায়েগা’’ বলে গান্ধী নেহেরু মোদী,-যোগী-প্যাটেলদের কাঙ্খিত দেশটাও মানব কল্যাণে ‘‘সাকসেসফুল’’ হবে বলে ভরসা কুড়োচ্ছেন?
হয়তো, প্রকৃত সমাধানটা কী হবে বলে প্রশ্ণটা নিয়ে ‘যুদ্ধংদেহি’ মানসিকতাও আপনার মনের ভেতরটাকে তোলপাড় করে তুলেছে৷ তাই শুনুন৷ প্রকৃত সমাধান হচ্ছে, প্রাউট প্রবক্তা সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রাউট তথা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্বের বাস্তবায়ন৷ যা হ’ল বর্তমানেরঃ---(১) পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের বদলে ‘প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা (২) অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা (৩) অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রিকরণ (৪) সমাজ থেকে শোষণের মূলোচ্ছেদ করতে পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন৷ (৫) ভাষাভিত্তিক রাজ্যঘটনের অথবা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজ্য রাষ্ট্র ঘটনের পরিবর্তে সামাজিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে শোষণমুক্ত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল ঘটন (৬) ব্লকভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ (৮) জিডিপি-র পরিবর্তে প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার গ্যারান্টি প্রদান, ইত্যাদি৷
- Log in to post comments