ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালী আর কতদিন বলির বকরা হয়ে থাকবে

লেখক
মনোজ দেব

মানুষ আজ অমানুষে পরিণত হচ্ছে৷ হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থ লোভ মানুষকে বিবর্তনের বিপরীত পথে নিয়ে চলেছে৷ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে কেউ তৃণমূল, কেউ বিজেপি নানা নামে পরিচিত৷ মানুষের পরিচয় সে ভুলে যায়, মানব ধর্মের অনুশীলন সে করে না৷ দলীয় স্বার্থরক্ষা করা আর অর্থ উপার্জন তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান৷ ক্ষমতার দখল নিতে সে উন্মত্ত, উন্মাদ৷ তাই তো এত হিংসা, এত রেসারেসি! কেউ একবারও ভাবে না কে কাকে মারছে? কে কার রক্তে হাত রাঙাচ্ছে? মিডিয়ায় কাণ রাখুন আর চোখ রাখুন,শুণবেন দেখবেন এক পার্টি আর পার্টিকে মেরেছে৷ কোন পার্টির ক্যাডার, কোন পার্টির কর্মী এটাই আসল পরিচয়৷ কখনও কেউ বলে না, মানুষ মানুষকে খুন করেছে, ভাই ভাইকে খুন করেছে!

স্বাধীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যষ্টিগত ও দলীয় স্বার্থে কিছু মানুষকে দ্বিপদ জীবে পরিণত করেছে৷ ক্ষমতার কুর্সী দখল করতে জনগণের বিশ্বাস, আস্থাৃ সমর্থনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলি নির্ভর করে না৷ বোট বৈতরণী পার হতে তারা ওইসব দ্বিপদ জীবের ওপর নির্ভর করে৷ তারই বিষময় ফল আজ ভোগ করতে হচ্ছে৷ পাশবিক উল্লাস, স্বজন হারানোর হাহাকার, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের গা-সওয়া হয়ে গেছে৷ তাই গণতন্ত্রের উৎসব নরমেধ যজ্ঞে পরিণত হয়৷ একের পর এক খুন হয়, নেতারা বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি দিয়ে দায় সারেন৷ স্নেহ, প্রেম, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, হৃদয়ের এই সুকুমার বৃত্তিগুলো খুইয়ে বসেছে ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে৷ তাই আজ যে ভাতৃহত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছে এর দায় নেতা-নেত্রীরা অস্বীকার করতে পারেন না৷ তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উস্কানিতেই এই হানাহানি চলছে৷ অথচ নেতাদের গায়ে আঁচড়টি লাগে না৷

বাঙলায় আজ যা কিছু ঘটছে, খুন, সন্ত্রাস, এ সবের পেছনে অমানুষ নেতাদের কালো হাতের অঙ্গুলীহেলনেই হচ্ছে৷ রাজনীতির নামে খুন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্মের নামে বিদ্বেষ, অনাচার, ব্যভিচার, সংস্কৃতির অঙ্গনে নগ্ণ বেলেল্লাপনা, শিক্ষার অঙ্গনে উচ্ছৃঙ্খলতা---এককথায় মানুষকে অমানুষ করার সব উপকরণ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের করায়ত্ত৷

একটা কথা খুব কৌশলে প্রচার হচ্ছে পশ্চিম বাঙলার মত এত খারাপ আর কোন রাজ্য নয়৷ প্রশ্ণ এখানেই যে পশ্চিম বাঙলা এত খারাপ হচ্ছে কেন? আর এতই যখন খারাপ ভিন রাজ্য থেকে এত মানুষ কেন পেটের দায়ে এই রাজ্যে ছুটে আসছে? ২০১১-র লোক গণনার হিসাবে ১০ বছরে ১৫৪ শতাংশ মানুষ ভিন রাজ্য থেকে পশ্চিম বাঙলায় এসেছে৷ তবু বাঙলা এত খারাপ!

যে বাঙলা এক সময় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, বিজ্ঞান---সব কিছুতেই শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান করে নিয়েছিল, তার কেন আজ এই দুরবস্থা? কেন আজ বাঙলার মাটিতে এই ভাতৃহত্যার রাজনীতি৷ এতে কার লাভ হচ্ছে?

বাঙালীর দোষগুলোই আজ বড় করে দেখানো হচ্ছে৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিকৃত করে স্বাধীনতার সব কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে অন্যকে৷ অথচ ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে পালিয়েছে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ভয়ে৷ ঐতিহাসিকরা এই সত্য স্বীকার করেছেন৷

কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বাঙলার মাটির প্রতি লোভ দেশীয় পুঁজিপতিদের আছেই৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশীয় পুঁজিপতিদের সমালোচনা করে বলেছিলেন---‘ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তি অর্জন করছে দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে৷ পরিণতিতে সুভাষচন্দ্রকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে উৎখাত করা হয়েছে৷ সিঙ্গুরের বহু ফসলী উর্বর জমি থেকে টাটাকে উচ্ছেদ করেছে তৃণমূল নেত্রী৷ সেই অপমান কর্পোরেট ইণ্ডিয়ার পক্ষে হজম করা শক্ত৷ কাঁচরাপাড়ার ওয়াগন ব্রেকার আর ভাটপাড়ার অবাঙালী মাফিয়াকে নিয়ে এই কর্পোরেট ইণ্ডিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়ার পরিণতি তৃণমূলকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷

তৃণমূলের যা হবার তাই হবে, কিন্তু বাঙালীর ভবিষ্যৎ কি? বাঙালী কোন্‌ পথে হাঁটছে? এবার ভেবে দেখার সময় এসেছে৷ কংগ্রেস ছিল পুঁজিপতির রক্ষক৷ বিজেপি সেই পুঁজিপতিদের হাতে গড়া দল যারা তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী, রামমোহন - রবীন্দ্রনাথের নাম শুনলে যাদের গা জ্বলে, যারা কোন বাঙালীকেই বিশ্বাস করে না৷ এখানে যে সব বাঙালী বিজেপি করে তাদের কাছে বাঙলা অপেক্ষা হিন্দী অনেক বেশী আপন৷ তাই ত্রিপুরায় বাংলা তুলে আজ হিন্দীর প্রচলন শুরু হয়েছে৷ পশ্চিম বাঙলাতেও সেই প্রচেষ্টা চলছে৷

বাঙলার ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি কোন কিছুর প্রতি যাদের ছিঁটেফোটা শ্রদ্ধা নেই, যাদের একমাত্র লক্ষ্য বাঙলার উর্বর জমি দখল করা, বাঙলার খনিজ সম্পদ যা ইতোমধ্যেই দিল্লীর দখলে, এখন বাঙলার মসনদে বসে বাঙালীকে পশ্চিমবাঙলায় সংখ্যালঘুতে পরিণত করাই শুধু বাকি৷

বাঙালীর স্বভাবসিদ্ধ পুঁজিবাদ বিরোধী মানসিকতা, ধর্মীয় কুসংস্কার ও ভাবজড়তা-মুক্ত উদার মনের সুযোগ নিয়ে বাঙলায় অবাঙালী অনুুপ্রবেশ ঘটে চলেছে, যার লক্ষ্য পশ্চিমবাঙলাকে অবাঙালী প্রধান রাজ্যে পরিণত করা৷ বাঙালীকে আজ তার ভবিষ্যৎ পথ ঠিক করে নিতে হবে৷ হয় তাকে রাজনীতির এই পরিণতি মেনে বলির বকরা হতে হবে, নতুবা ভাতৃহত্যার রাজনীতি ভুলে, দলীয় কোন্দল ছেড়ে বাঙালী পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ বাঙালীর সামনে অন্য কোন পথ নেই৷