আমার মনে হয়, প্রপত্তি সম্পর্কে আমার কিছু বলা দরকার৷ বোধ হয়, সেটা আমার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব ও কর্ত্তব্যও৷ সংস্কৃতে প্র–পত্+ ক্তিন প্রত্যয় করে ‘প্রপত্তি’ শব্দটি নিষ্পন্ন৷ প্রপত্তির পেছনে মূল ভাবটা, মূল তাৎপর্যটা হচ্ছে এই যে আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু ঘটে চলেছে সবই পরমপুরুষের ইচ্ছার অভিপ্রকাশ৷ তার আদেশ(order) বিনা আগ্ণেয়গিরির অগ্ণ্যুদগীরণও হবে না, এমনকি একটা ঘাসের পাতাও নড়বে না৷ তাই পরমপুরুষ আগে থেকেই যেমনটি বন্দোবস্ত করে রেখেছেন, যেমনটি পরিকল্পনা করে রেখেছেন ঠিক তেমনটিই ঘটে চলেছে৷
মানুষ কিছুই করতে পারে না, কোন জীবিত প্রাণীই কিছু করতে পারে না পরমপুরুষের সমর্থন না থাকলে৷ অর্থাৎ যখন মানুষের ইচ্ছা পরমপুরুষের ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়, কেবল তখনই মানুষের ইচ্ছা ফলপ্রসূ হয়, নইলে মানুষের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়৷ যখন জীবের বাসনা আর কৃষ্ণের ইচ্ছা এক হয়, তখনই সে ইচ্ছায় ফল ফলে, নচেৎ তা নির্ঘাত ব্যর্থ হয়৷ ‘প্রপত্তি’ শব্দের এইটাই মর্মার্থ, এইটাই প্রকৃত ভাবনির্যাস৷
ভক্তিবাদ তত্ত্বটা পুরোপুরি এই প্রপত্তির ওপরেই আধারিত৷ জ্ঞানবাদ জিনিসটা প্রপত্তিকে সমর্থন করে না, ভক্তিবাদ কিন্তু ষোল আনা এই প্রপত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে৷ কেউ কেউ হয়তো প্রপত্তিবাদের বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে প্রশ্ণ তুলতে পারেন৷ জ্ঞানী হয়তো বলতে পারেন, যদি সব কিছু পরমপুরুষের ইচ্ছায় বা সংকল্পেই হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের বৈয়ষ্টিক প্রচেষ্টার দরকারই বা কী? জ্ঞানী হয়তো ভাবতে পারেন–ভক্তের পক্ষে এটা একটা দুরূহ প্রশ্ণ, ভক্ত বোধ হয় এ প্রশ্ণের সদুত্তর দিতে পারবেন না৷ কিন্তু জান তো, যদিও জ্ঞানমার্গীরা ভেবে থাকেন যে তাঁরা সবচেয়ে জ্ঞানী বা অতি বুদ্ধিমান আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, ভক্তরাই জ্ঞানমার্গীদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান৷ আর যে মানুষটা ভাবে যে সে জ্ঞানী, আমি তো বলব, সে–ই হ’ল সবচেয়ে মূর্খ৷
আমি আগেই বলেছি, একজন তথাকথিত জ্ঞানী একটা অতি সামান্য তৃণখণ্ডকেও নাড়াতে পারবে না কিন্তু যে মানুষটা ভক্ত, যে ভগবানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলে সে তা পারবে৷ এখানেই ভক্তের শ্রেষ্ঠত্ব৷ আসল ব্যাপারটা হ’ল এই যে মানুষের যোগ্যতা, মানুষের শক্তি–সামর্থ্য, কর্মনৈপুণ্য প্রায় কিছুই নেই বললেই চলে৷ সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের নিজের বলে কিছুই নেই৷ তার যা কিছু সবই সে পেয়ে থাকে পরমপুরুষের কাছ থেকে৷
দেখ না, মানুষ যদি একনাগাড়ে মাত্র তিন/চার দিন না খেয়ে থাকে অথবা ধর তিন/চার/পাঁচ বছর ধরে–তাহলে তার ভৌতিক অস্তিত্বটার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না৷ তার নড়ন–চড়নও ক্ষন্ধ হয়ে যাবে.... কথা বলবার শক্তিও রহিত হয়ে যাবে৷ তাহলেই বোঝ, মানুষের নিজের বলে আছেটা কী ভক্ত জানে, তার যা কিছু সবই ভগবানের এমনকি সে নিজেও তো পরমপুরুষেরই সম্পত্তি৷ তাই ভক্তের প্রথম কথাই হ’ল–মানুষ নিজের চেষ্টায় কিছুই করতে পারে না৷
জাগতিক জ্ঞান, বৈষয়িক বুদ্ধি, তথাকথিত মানবীয় বিদ্যা–বুদ্ধি–জ্ঞানগ–এসবের বাস্তব মূল্য কতটুকু৷ এ ধরনের জ্ঞানকে বলে প্রাপ্ত বাক্য অর্থাৎ যে জ্ঞানটা বিভিন্ন পার্থিব মানুষের মাধ্যমে, জাগতিক সত্তার অভিব্যক্তির মাধ্যমে এসে থাকে৷
পুরোনো ভূগোলের বইয়ে দেখে থাকবে, এককালে উত্তর প্রদেশের রাজধানী ছিল এলাহাবাদ৷ পরবর্তী কালের ছাপানো বইয়ে দেখবে, ওই একই উত্তর প্রদেশের রাজধানীর নাম লক্ষ্ণৌ লেখা আছে৷ ভবিষ্যতে আরও অন্য কিছু দেখতে পাবে৷ প্রাপ্ত বাক্যের এই তো অবস্থা৷ প্রাপ্ত বাক্য হ’ল আপেক্ষিক জিনিস তাই তা পরিবর্তন–সাপেক্ষ৷ তাই ভক্ত সব কিছু চেলে নেয়, খাঁটি জিনিসকে বাজিয়ে নেয়৷ আর জ্ঞানীরা করে কী? –না, তাদের পুঁথিগত বিদ্যার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে অযথা ঝগড়াঝাঁটি করে–হামেশাই৷
যে খাঁটি ভক্ত তার কাছে কেবল আপ্তবাক্যেরই মূল্য আছে৷ পরমপুরুষের কাছ থেকে স্বতঃ উৎসারিত যে জ্ঞান সেটাই আপ্তবাক্য৷ ভক্ত পরমপুরুষের সঙ্গে নিবিড় ভালবাসার সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়৷ এই ভক্তির বলে সে পরমপুরুষের ইচ্ছাকে শুণতে, জানতে, বুঝতে, উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়৷ সেইটাই তার কাছে আপ্তবাক্য৷ তোমরা ভক্ত মানুষ, তাই শুধু আপ্তবাক্যকেই মেনে চলবে৷ মনে রেখো, তোমাদের পালনীয় ষোড়শ বিধি তোমাদের পক্ষে আপ্তবাক্য৷
প্রপত্তিই হচ্ছে তোমাদের জীবনাদর্শের মূল ভিত্তি৷ আর প্রপত্তির মূল বক্তব্য হ’ল–পরমপুরুষের ইচ্ছাই সব কিছু, যা কিছু ঘটবে সবই তাঁর ইচ্ছা তাঁর বিনা অনুমতিতে একটা ঘাসের পাতাও নড়তে পারেনা৷ পরমপুরুষের কৃপায়, তাঁরই করুণায় আপ্তবাক্যের নির্দেশনা পেয়েছ সেই শিক্ষা, সেই নীতিকথাকে কঠোর ভাবে মেনে চলা তোমার মহৎ কর্ত্তব্য৷ মনে রেখো, তথাকথিত জ্ঞানীর কোন ভবিষ্যৎ নেই৷ (পটনা, ১০ই সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)