সব রাজনৈতিক নেতারাই তারস্বরে গণতন্ত্রের সুনাম করেন৷ রাজতন্ত্র, অভিজাত–তন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব নয়– এমন বোধ করি একজনও নেতা বা নেত্রী পাওয়া যাবে না৷ তবুও এ প্রশ্ণটা অত্যন্ত সঙ্গত যে– গণতন্ত্রকে কেউ কি মানে নির্বাচনের দামামা বাজতেই নেতাদের মুখের ভাষা, অঙ্গ ভঙ্গীমায় গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই৷ নির্বাচনী প্রচার মরণের উন্মাদরাগিনী৷ নির্বাচনে জিততে নেতারা জনসমর্থনের ওপর আর ভরসা রাখে না৷ পেশিবল, অর্থবল, প্রশাসনিক ক্ষমতাকে শাসকদলের অনুকুলে ব্যবহার করা ভারতীয় গণতন্ত্রের অঙ্গ হয়ে গেছে৷ জনগণতন্ত্রের শাসনে জনগণই গৌণ হয়ে গেছে৷
গণতন্ত্র মানে তো জনগণ, কারও চাপে নয়, স্বাধীন ভাবে বিচার–বিবেচনা করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে৷ আর সেই জনপ্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবে৷ তবে তাকে বলা হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্যে–জনগণের সরকার৷ একেই বলে গণতন্ত্র৷ কিন্তু এই গণতন্ত্র তখনই সফল হবে যখন প্রতিটি মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সচেতন হবে ও জীবনধারণের প্রাথমিক প্রয়োজন (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) পূর্তি হবে৷
জনমতকে তাদের পক্ষে রাখার জন্যে বিভিন্ন পার্টি তাদের নীতি জনগণকে বোঝাবে, অন্যান্য পার্টির নীতির চেয়ে তাদের নীতি ও কার্যক্রম যে সর্বোৎকৃষ্ট– তা প্রতিটি পার্টি প্রচারপত্র, ফেষ্টুন, মিটিং প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে বোঝাবে৷ তারপর জনগণ তাদের পছন্দ মত প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে৷ এটাই তো গণতন্ত্রের নীতি৷
কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে, পার্টির নেতা–নেত্রীদের বক্তব্যে নিজ নীতি ব্যাখ্যার চেয়ে অন্যকে গালাগালি বেশী করে থাকে৷ এমনকি ভদ্র সমাজে কহতব্য নয়–এমন ভাষাও ব্যবহার করা হয়৷ প্রতিপক্ষকে হুমকী দেওয়া হয়৷ ঘরে ঘরে গিয়ে পার্টির ক্যাডাররা নিরীহ জনগণকে নানান, প্রলোভন দেখান, হুমকীও দিতে দ্বিধাবোধ করেন না৷ প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা, মারধোর, খুন, জখম করে’ একটা সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যাতে করে জনগণ প্রতিপক্ষকে ভোট দিতে সাহস না করে৷ সর্বত্রই নেতানেত্রীরা সব জেনেও এই জিনিসটাকে প্রশ্রয় দেন৷
এ থেকে তো সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায়, আসলে নেতা–নেত্রীরা মুখে গণতন্ত্রের জয়গান গাইলেও গণতন্ত্রের ওপর এদের কারোর আস্থা নেই৷ এদের আস্থা ‘ জোর যার মুলুম তার’–এই নীতির ওপর৷ অর্থাৎ বলা বাহুল্য বাহুৰল, অর্থৰলের ওপরেই এদের আস্থা–গণতন্ত্রের ওপর নয়৷ আজকের সমাজে বৈশ্যযুগ চলছে৷ অর্থাৎ দুনিয়াটা কার বশ আজকের পরিস্থিতিতে এর উত্তর, দুনিয়া টাকার বশ৷ তাই যাদের হাতে টাকা আছে, অর্থাৎ পুঁজিপতিরা এই সুযোগ গ্রহণ করে’ টাকার বস্তা নিয়ে বসে থাকে৷ যে পার্টি তাদের কারবারে সাহায্য করবে–তাদের তারা দরকার মত টাকার বস্তা সরবরাহ করবে৷ যে টাকা নিয়ে গুণ্ডা পোষাও যাবে ও টাকা ছড়িয়ে ভোটও কেনা যাবে৷
আশা করি, উদাহরণ দিয়ে এটাকে বোঝাতে হবে না৷ একটু চোখ–কাণ খোলা রাখলে ও ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখলেই এটা সহজে হূদয়ঙ্গম করা যাবে৷
তাহলে গণতন্ত্র কোথায় এসে দাঁড়াল গুণ্ডাতন্ত্র হয়ে পুঁজিবাদতন্ত্রে৷ ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রের পূজারী নামে যাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেই সর্বত্রই এই জিনিসটা দেখা যাবে৷ খুব বেশি আগে গিয়ে লাভ নেই৷ কেননা, আগের ব্যাপারে সবার অভিজ্ঞতা নেই৷ কিন্তু বামফ্রণ্টের ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতা তো আজকের বেশির ভাগ মানুষের স্মৃতিপটে এখনও জ্বলজ্বল করছে৷ কংগ্রেসকে সরাসরি পুঁজিবাদের দালাল বলে’ যে সাচ্চা () কম্যুনিষ্টরা এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, নিজেদের তারা প্রগতিশীল বলত, প্রকৃত জনগণের সরকার বলে নিজেদের দাবী করত, তারাই তো এরাজ্যে গণতন্ত্রের নামে চরম সন্ত্রাস আমদানী করেছে৷ প্রতি কথাতেই তারা ‘জনগণ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতান্ত্রিক’ মন্ত্র জপ করত৷ কিন্তু বাস্তবে তারা গুণ্ডাতন্ত্র বা হার্মাদতন্ত্রই কায়েম করেছিল৷ বর্ধমানের সাঁইবাড়ী হত্যাকাণ্ড, মরিচঝাঁপিতে বাঙালী গণহত্যা, বিজনসেতু সন্ন্যাসী হত্যা, আনন্দনগরের সন্ন্যাসী হত্যা, নেতাই, লালগড়, গড়বেতা, নন্দীগ্রাম–সর্বত্র গণহত্যার রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল৷ এ রাজ্যে গণতন্ত্রের মেশিনটাকে এমন বানিয়েছিল যে এসব করেও বার বার নির্বাচনে তারাই বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে জয়লাভ করত৷ জনগণকে কাঠের পুতুল হিসেব সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে হার্মাদরাই ভোটের বাক্স ভরে দিত৷ কারোর কিছু বলার ছিল না৷ বললেই বা কে মূল্য দিত দীর্ঘ ৩৪ বছর পর জনগণের মধ্যে সৃষ্ট চরম ক্ষোভ ও মমতার মরণপন লড়াই শুধু নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে বুথে বুথে হার্মাদ বাহিনীর পৈশাচিক নৃত্য বন্ধ করতে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিল, তখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হ’ল৷ আজ আর ক্যাডার নয়, অভিযুক্ত প্রযুক্তি, ই.ভি.এম মেশিনে বোটে কারচুপির অভিযোগ উঠছে৷ প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ক্ষমতার অব্যবহার গণতন্ত্রের লজ্জা৷ ভারতীয় গণতন্ত্র আজ সেই লজ্জায় মুখ ঢ়েকেছে৷ শাসকের রক্তচক্ষু অর্থবল নির্বাচনে জয়লাভের বড় ভরসা৷ এখানে জনগণের প্রতি কোন আস্থা নেই৷ গণতন্ত্রের নামে এ এক প্রহসন৷
তাহলে পথ কী মানুষ না পরিবর্তন হলে একই মানুষগুলোই তো দেখা যায় কংগ্রেস থেকে সিপিএমে, সিপিএম থেকে তৃণমূলে, আবার তারাই ভীড় জমাচ্ছে নতুন মাথা তোলা বিজেপিতে৷ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির তো একই দশা সেই পুরাতন পানীয় নতুন বোতলে৷ ভারতীয় রাজনীতির এ এক বিষাক্ত বৃত্ত৷ যে যতই দলত্যাগ করুক, অন্যদলে যোগ দিন অথবা নিজে দল করুক কিন্তু এই বিষাক্ত বৃত্তের বাইরে কেউ আসতে পারে না৷
তাই নোতুন করে দেশকে গড়তে গেলে তার সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুত করতে হলে চাই নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষ, চাই নতুন নীতি, নতুন পরিকল্পনা৷ কেবল ওপরে–ওপরে পরিবর্তনে লাভ হবে না৷ ভেতর থেকে পরিবর্তন চাই৷
- Log in to post comments