আর.জি.কর ঘটনা আবার মনে করিয়ে দিল চরম দণ্ড তথা অপরাধীর প্রাণদণ্ড দিলেও সমাজ অপরাধ মুক্ত হয় না৷ তবু অর্বচীনের মানুষ আবারও পথে নামে অপরাধীর চরম দণ্ডের দাবীতে৷ আশ্চর্যের বিষয় অর্বাচীনের মধ্যে অনেক তথাকথিত সুশীল সমাজের কেউ–কেটারাও আছেন৷ অপরাধের উৎস মূখ বন্ধ করার দায় কিন্তু ওই তথাকথিত সমাজের৷
কিন্তু সমাজে এই অপরাধ বন্ধের জন্যে ,নিজেদের দায় অস্বীকার করে প্রশাসনকে গালমন্দ করছেন আরও শক্ত হতে উপদেশ দিচ্ছেন৷ আর একটু এগিয়ে কিছু বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবী আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও কড়া আইন প্রবর্তনের সুপারিশ করছেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যপক সমালোচনার চাপে পড়ে সরকার নোতুন আইন প্রবর্তন করছেন যেমন দিল্লীর ধর্ষণের ঘটনায় বিচলিত হয়ে সরকার ধর্ষণ বিরোধী নোতুন বিল এনে লোকসভায় ও রাজ্যসভায় পাশ করালেন৷ কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না!
শুধু এই অপরাধই নয়, অজস্র এ ধরনের এমনি অপরাধ প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে৷ দুর্নীতিতে তো গোটা দেশটা ছেয়েই গেছে৷ আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই এসব ঘটছে আর যাদের হাতে আইনকে কার্যকরী করার ভার তারাই আইন ভঙ্গ করে বেআইনী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে৷
আসলে এটা যে একটা ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি– এটা কি কেউ বুঝতে চেষ্টা করছেন না! এই ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি মহামারীর মত গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই এই মারাত্মক ব্যাধির পেছনে কোন্ ভাইরাস কাজ করছে, এই ভাইরাস ধ্বংস করার কী উপায় –সেটাই আজ ভাবতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের জীবনেই আছে কিছু সহজাত বৃত্তি৷ এই বৃত্তিগুলি কিছু মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়৷ প্রাউটের দৃষ্টিতে যে সকল বৃত্তি মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়৷ সেগুলিকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য, আবার যেগুলি মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায় সেগুলিকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য, আবার যেগুলি মানুষকে অবনতির পথে নিয়ে যায় সেগুলিকে নিরুৎসাহিত করা উচিত৷
এখন প্রশ্ণ সমাজকে পাপমুক্ত করার এই মহৎ দায়িত্ব নেবে কে শাসক দলের দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা, ইত্যাদি৷ কিন্তু মানব মনের অপরাধ প্রবনতাকে বিনাশ করা শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসন, আইন আদলতের দ্বারা সম্ভব নয়, হ্যাঁ, কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রশাসন অপরাধীকে দমন করে রাখতে পাবে, কিন্তু তা সাময়িক অপরাধী পুলিশ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে তার কামনা চরিতার্থ করার নানা কৌশল অবলম্বন করে৷
সমাজকে পাপমুক্ত করতে কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের একটা ভূমিকা থাকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’,শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ দিনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পন তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশ প্রেম সঞ্চার করেছিল, তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বইগুলি নিষিদ্ধ করেছিল৷ আজ বিপরীত ধর্মী সাহিত্য চলচিত্র, সঙ্গীত যুব সমাজকে কুপথে ঠেলে দিচ্ছে৷ তাদের মনে হীন বৃত্তিগুলিকে উৎসাহিত করছে৷ তাই হাতরাস থেকে আর.জি.কর– এই সামাজিক ব্যভিচারের দায় সুদীর্ঘ সমাজ অস্বীকার করতে পারেন না৷ কিন্তু তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে সব দায় শাসকের ঘাড় চাপিয়ে দেয়৷
একথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই আজকের সমাজ সর্বগ্রাসী নররূপী দানবের করায়ত্ব৷ কবি সাহিত্যিক শিল্পীরাও তাঁদের সর্জনী শক্তির ব্যবহার করছেন এই দানবের ইচ্ছামত৷ তাই সমাজে অশ্লীল নগ্ণ সাহিত্য চলচিত্রে ভরে যাচ্ছে– যা তরুণ সমাজকে অধঃগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ তাই শুধুমাত্র প্রতিবাদ করে, রাত দখল করে এই অপরাধ দমন করা যাবে না৷ ও বিকাশের পথে চলতে উৎসাহিত করতে যেমন প্রয়োজন উন্নত ভাবনার আদর্শ সাহিত্য সঙ্গীত শিল্প রচনা করতে হবে পাশাপাশি মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে সবরকম ভাব–জড়তা কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা ত্যাগ করে প্রকৃত ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনের অনুগামী হতে৷
এই ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন শেখায়, সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সমস্ত মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ভূমাচৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া৷ তখনই মানুষ পাবে জীবনের পূর্ণ আনন্দ–পরিপূর্ণ প্রশান্তি৷ এই ঈশ্বর কেন্দ্রিক দর্শন ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখায়৷ আর ঈশ্বর সবার মধ্যে বিরাজিত৷ তাই এই দর্শন ঈশ্বরজ্ঞানে জগতের সবাইকেই ভালবাসতে শেখায়৷ সবার প্রতি পবিত্র কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দেয়৷ ঈশ্বর ভাবনা মনকে পবিত্র করে –সূক্ষ্ম দিকে পরিচালিত করে, তাকে নৈতিকতায, নব্যমানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ করে৷ এটাই প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷
এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষকে যথার্থ নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষের মনকে সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্ত করতে পারে৷ কিন্তু বর্তমানে দেশের নেতা–মন্ত্রীরা তথা আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এই আধ্যাত্মিকতাকে বর্জন করে সমাজের উন্নতি করতে চান– যা কখনোই সম্ভব নয়৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া মানুষের মন কখনোই কলুষমুক্ত করা যাবে না৷
বর্তমানের নেতা–নেত্রী তথা বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ পূর্বোক্ত প্রথম তিন প্রকার দর্শনের ধারক ও বাহক৷ এই কারণে এই তিন দর্শনের গণ্ডীর মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে যতই তাঁরা সমাজকে কলুষমুক্ত করার কথা উচ্চকন্ঠে প্রচার করুন না কেন, তাঁরা ব্যর্থ হবেনই৷ যথার্থ আধ্যাত্মিক শিক্ষা ছাড়া কোনো আইনই সমাজকে ব্যাভিচার, পাপাচার ও দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে পারবে না৷
- Log in to post comments