অর্থাৎ বৈশ্য–যুগেই বস্তুর বৈবহারিক মূল্য সবচাইতে কমে’ যায়৷ বস্তু স্ব–ভাবে বা টাকার অঙ্কে ক্রমশঃ স্থানু হয়ে পড়তে থাকে৷ বৈশ্য যুগে এইটেই সব চেয়ে বড় অভিশাপ৷ কারণ ভোগ্য বস্তুর গতিশীলতা যেখানে যত কম, বা অন্য ভাষায় বলতে গেলে, বিশেষ বিশেষ প্রকোষ্ঠে তার স্থিতিশীলতা যত বেশী, ততই তা জনসাধারণের পক্ষে অধিকতর ক্ষতির কারণ হতে থাকে৷
এত বলার পরেও বলছি, পৃথিবীর কোন কিছুই অবিমিশ্র ভাবে খারাপ বা ভাল নয়৷ ব্যষ্টিগত বা সমষ্টিগত যে কোন প্রচেষ্টাই হোক্ না কেন তার গোড়ায় একটা পুঁজি থাকার দরকার–তা সে টাকার অঙ্কেই থাক, বা বস্তু হিসেবেই থাক৷ বৃহৎভাবে বা ব্যাপকভাবে পুঁজি সৃষ্টি করবার সুযোগ এই বৈশ্যযুগেই আসে, আর এই পুঁজি কাজে লাগিয়ে শুধু বৈয়ষ্টিক* জীবনেই নয়, সামূহিক জীবনেও সম্পদ সৃষ্টি করা যায়৷
সামাজিক শোষণের প্রশ্ণে বিপ্র ও বৈশ্যযুগের ধরণ–ধারণে খানিকটা মিল আছে৷ তাই সমাজ–ব্যবস্থায়, সমাজিক আইনে বা নারী–পুরুষের মর্যাদা নির্ধারণের প্রশ্ণে, বা দায়াধিকার ব্যবস্থায় বৈশ্যযুগ মোটামুটি বিচারে বিপ্রযুগেরই অনুসরণ করে৷
অবশ্য বৈশ্য–প্রধান সমাজ–ব্যবস্থার স্বভাবই এই যে, অনেক ভাল ভাল আইন তৈরী করা হয় জনসাধারণের কাছ থেকে সস্তা তারিফ পাবার জন্যে, কিন্তু কোন প্রকারের আইন কঠোর ভাবে বলবৎ করা হয় না৷ কারণ তা’ করা হলে শোষণের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়৷
বৈশ্য যুগে মানুষের মর্যাদা টাকার অঙ্কে নিরূপিত হয়৷ মানুষের এই ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ণের প্রভাব কেবল মর্যাদার ক্ষেত্রেই সীমিত নয়, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ফল হয়ে দাঁড়ায় সুদূর প্রসারী৷ নিজস্ব মতবাদ, মর্যাদাবোধ বা স্বাতন্ত্র্যবোধ যার আছে, সহস্র যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সেই বিপ্র বা ক্ষত্রিয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না–যদি না সে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে বৈশ্যের স্তাবকতা করতে শেখে৷ বস্তুতঃ বৈশ্যযুগে বিত্তবান ব্যতিরেকে বাকি কেউই সম্মানের আশা করতে পারে না৷ যারা আশা করে বা পেয়েছে তাদের বৈশ্য কৃপার ওপরেই নির্ভর করতে হয় বা হয়েছে৷ ‘সর্বে গুণাঃ কাঞ্চনমাশ্রয়ন্তি’৷
বৈশ্য–ভাবনায় জাগতিক সম্পদ অনেককে বঞ্চিত করে’ অল্পের মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে বলে’ বৈশ্যরা সব সময়েই সংখ্যাল্প, আর তাদের শোষণের উপকরণ ও শোষণের যন্ত্র হিসেবে থেকে যায় যারা–তাদেরই সংখ্যাধিক্য৷ শোষিত চিনির বলদের মত এই যে সংখ্যাধিক জনসাধারণ –এদের পঙ্গু মন ভাবতে থাকে যে, চিনি খাবার অধিকার তাদের নেই৷ তাদের এই ভাবনাই বৈশ্যের পরম বন্ধু৷ বৈশ্যরা সর্বতোভাবে–প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের মনে এই ভাবনাকেই পরিপুষ্ট করে’ রাখতে চায়, আর এ জন্যেই তারা রকমারী ইজ্মের ও আকাশ–ছোঁয়া তত্ত্ব–কথার আমদানী করতে চায় শূদ্রাবস্থা–প্রাপ্ত বেতনভূক বিপ্রদের সাহায্যে৷ চিনির বলদের দল যখন শোষণ সহ্য করতে না পেরে মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখনই বৈশ্য যুগের অবসান হয়৷
বর্তমান যুগ
বৈশ্য–প্রধান সমাজব্যবস্থা আজও চলছে৷ শোষণের ফলে বিপ্র ও ক্ষত্রিয় ক্রমশঃ শূদ্রত্বে পর্যবসিত হয়ে চলেছে৷ স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজে বিত্তশালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে না৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এই শূদ্রেরই৷ এই শূদ্রেরা আজ চাইছে মিলিতভাবে বৈশ্য–প্রধান্য খর্ব করতে, তাদের ধ্বংস করতে৷ তাই আজ জাগছে একটা শূদ্র–প্রাধান্যের সূচনা৷
যারা দৈহিক বলের দ্বারা বা মনোবলের দ্বারা নিজেদের শাসন অক্ষুণ্ণ রেখেছিল তাদের শ্রমজীবীর শ্রমের ওপরে নির্ভর করতে হ’ত না, আর শ্রমজীবীরাও তৎকালে তাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে নি৷ কিন্তু পুঁজিপতিরা শ্রমিকের সাহায্য ব্যাতিরেকে তাদের সম্পদ বাড়াতে পারেনি, তাই পুঁজিপতির শাসন ব্যবস্থায় শাসকের নিকট শ্রমের মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, এইভাবে শ্রমিকরাও তাদের গুরুত্ব বুঝতে শিখল৷ ফলতঃ শাসন ক্ষমতা অধিকার করবার জন্যে তাদের চেষ্টা সাম্যবাদ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে৷
শূদ্রের দৃঢ়–নিবদ্ধ সমাজ না থাকায় তথা বৌদ্ধিক অল্পতা নিবন্ধন সমাজ শাসন তাদের দ্বারা হয় না৷ তাই শূদ্র–বিপ্লবে* যারা নেতৃত্ব নেয়, বৈশ্যোত্তর যুগে শাসন ব্যবস্থা তাদের হাতেই আসে৷ এরা বীর, সাহসী৷ তাই দ্বিতীয়বার ক্ষাত্র–যুগের এরাই সূচনা করে৷৭
বর্তমান পৃথিবীতে দু’একটি অনগ্রসর দেশে আজও ক্ষাত্র যুগ বা বিপ্র যুগ চলছে৷ অধিকাংশ প্রাগ্রসর দেশে চলছে বৈশ্য যুগ৷ দু’একটি দেশে শূদ্র–ভ্যুত্থানের পর দেখা দিয়েছে নোতন ক্ষাত্র যুগ৷ কোথাও বা নোতুন বিপ্র যুগের সূচনা দেখা যাচ্ছে৷
ইতিহাসের বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগভৌমিক সিদ্ধান্ত
সভ্যতার বিবর্ত্তনের পরিঘূর্ণনে চারটি শ্রেণীর অবস্থিতি সুনির্দিষ্ট৷ এক একটি শ্রেণী এক এক যুগে আধিপত্য বিস্তার করে, আর সমাজচক্রের ঘূর্ণণের কারণে ক্রমশঃ সেই শ্রেণীর আধিপত্য কমে’ গিয়ে পরবর্ত্তী শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এইভাবেই চক্র ঘুরে চলেছে৷৬
ইতিহাস রচিত হয় সামূহিক মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে৷ শূদ্র যুগের পরে এসেছে সর্দারদের যুগ, অর্থাৎ ক্ষাত্র যুগ, তারপর বিপ্র যুগ, তারপর বৈশ্য যুগ, আর তারপর, যে ক্ষত্রিয়রা শূদ্র–বিপ্লবে নেতৃত্ব করেছিল তাদের যুগ৷ চক্র এই ভাবেই ঘুরে চলবে৷ সমাজচক্রের এই প্রবাহ চিরন্তন৷১
অর্থাৎ শ্রেণীচক্র ক্রমাগত বিবর্ত্তিত হয়েই চলবে, শ্রেণীসংগ্রাম চলার সঙ্গে সঙ্গে কোন বিশেষ যুগে কোন বিশেষ গোষ্ঠী (শ্রেণী) প্রাধান্য বিস্তার করবে৷