পূর্ব প্রকাশিতের পর–
আরও কিছুদূর এগিয়ে চলতে চলতে সে সামনে দেখলে আর একটা পাহাড়......তাঁবার*১
কিপ্ঢেকঞ্জুস দেখলে–ছ’পকেট ভরতি রূপোর টাকা নিলে তাতেও তিনটে অসুবিধে৷ প্রথমতঃ অত রূপোর টাকারই বা দাম কত দ্বিতীয়তঃ রূপোর টাকার ভারে সে দ্রুত চলতে পারবে না৷ তৃতীয়তঃ তাতে ঝমঝম শব্দ হবে তাতে চোর–ডাকাতের বুঝতে সুবিধে হবে যে সে অনেক টাকার মালিক৷
সেকালে এক টাকার নোট ছিল না৷ ইংরেজ যুগে কড়ির ব্যবহারও রহিত হয়ে যায়৷ ব্যবহার বেশী ছিল তাম্র মুদ্রা, ব্রোঞ্জ মুদ্রা, নিকেল মুদ্রা ও রৌপ্য মুদ্রার (খাদ–মেশানো সোনার মুদ্রার –যাকে ইংরেজীতে সব্রেন, বাঙলায় গিনি বলা হত যার থেকে গিনি সোণা–ব্যবহারও অল্পস্বল্প ছিল)৷ বিক্রেতারা তাই দিনে যখনই দোকান থেকে বাড়ীতে যেতেন বিক্রয়লব্ধ অর্থ পুঁটলিতে মজবুত ভাবে ক্ষেঁধে পুঁটলিকে ছোট্ট করে এমনভাবে নিয়ে যেতেন যাতে মুদ্রার কোনো আওয়াজ না হয়৷ একটি ছোটখাট বেনের পুঁটলিতে থেকে যেত অনেকগুলি টাকা৷
বেনের পুঁটলির কথা বলতে গিয়ে সেকালের একটা গল্পের কথা মনে পড়ল৷ একবার একজন গুরু অর্থসংগ্রহের জন্যে শিষ্যবাড়ী পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন৷ তখন শীতকাল.......সদ্য ধান উঠেছে৷ অর্থসংগ্রহের পবে সেটা ছিল খুব উপযুক্ত সময়৷ শিষ্যবাড়ীতে আসায় শিষ্য তাঁকে খুবই আদরযত্ন করলে৷ তখন তার হাতে দু’পয়সা রয়েছে৷ রাত্রে সে গুরুকে বললে–ঠাকুরমশায়, এখন শীতকাল৷ রাত্রে আপনি কম্বল না লেপ গায়ে দেবেন? আপনার জন্যে দুইই তৈরী আছে৷ গুরু ভাবলেন–এই সময়ে একটু মহাপুরুষ সাজা যাক
সেই যে একবার জঙ্গলের ধারে এক ফকিরের আস্তানার পাশে ঝড়ে অনেকগুলো কাক মরে পড়েছিল, লোকে বললে–‘‘ফকির সাহেব, জঙ্গলের এত কাক ঝড়ে মরল কেন?’’ ফকির বললে–‘‘কাকগুলো আমাকে বড্ড জ্বালাতন করত৷ কাল সন্ধেবেলা ওদের খুব শাসিয়েছিলুম৷ বলেছিলুম–তোরা যদি খুব ভদ্রভাবে থাকতে না পারিস তাহলে তোদের সবাইকে শ্যাষ করে দোব৷ একরাত কাটল না গো, এমন ঝড় এল যে সবাই মরে গেল৷ আমার আদেশ পালন করে ওরা যদি কা কা রব ছেড়ে কুহু কুহু রব শিখে নিত তাহলে ওদের এ দশা হত না৷’’
গুরুমশায় দেখলেন–কাক মরল ঝড়ে, ক্যারামতী পেল ফকির৷ তাই না বাংলায় প্রবাদ আছে–ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের ক্যারামতী বাড়ে৷ গুরুমশায় ভাবলেন–আমিও এই শিষ্যবাড়ীতে এসে একবার ক্যারামতী দেখিয়ে দিই৷
সে শিষ্যকে বললে–‘‘দেখ, আমরা সব মহাপুরুষ৷ আমাদের শীত–গ্রীষ্ম লাগে না৷ ওই লেপ–কম্বল কোনো কিছুরই দরকার নেই৷’’
গুরু খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লেন৷ শিষ্য মানুষটি খুবই ভাল৷ সে গুরুর দোরগোড়ায় কম্বল–মুড়ি দিয়ে বসে রইল৷ যদি গুরুর শীত করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে লেপ বা কম্বল দিয়ে দেবে৷ সে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলে–প্রথম প্রহরে গুরু হাত–পা লম্ক্ষা করে সটান হয়ে শুয়ে রয়েছে৷ সে আপন মনে বললে–‘‘প্রথম প্রহরে প্রভু ঢেঁকি অবতার’’৷ দ্বিতীয় প্রহরে গুরুর একটু শীত করছে ৷ শীতে তিনি হাঁটুকে একটু মুড়ে ফেললেন৷ শিষ্য বাইরে থেকে গেয়ে উঠল–‘‘দ্বিতীয় প্রহরে প্রভু ধনুকে টংকার’’৷ তৃতীয় প্রহরে শীত আরও বেড়েছে৷ গুরুর শরীর শীতে আরও কুঁকড়ে গেল৷ শিষ্য গেয়ে উঠল–‘‘তৃতীয় প্রহরে প্রভু কুকুরকুণ্ডলী’’৷ চতুর্থ প্রহরে শীত আরও বেড়ে যাওয়ায় গুরুর শরীরটা একেবারে গোল পাকিয়ে গেল৷ তাই দেখে শিষ্য গেয়ে উঠল– ‘‘চতুর্থ প্রহরে প্রভু বেনের পুঁটুলি’’৷ তা সে যাই হোক্, কিপ্ঢেকঞ্জুস বেনের পুঁটলি নিয়ে ঘোরাফেরা করতে চায় না৷
সে আরও এগিয়ে চলল৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলল৷ দিনের পর দিন..........মাসের পর মাস৷ চলে গেছে কত বিনিদ্র রজনী.....কত অজস্র বৃষ্টিপাত৷ কিপ্ঢেকঞ্জুসের কোনো দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই৷ লক্ষ্য তার সম্পদ আহরণ.........মন তার বলে চলেছে–‘‘ম্যাঁয় ভুখা হুঁ......ম্যাঁয় ভুখা হুঁ ’’৷
হঠাৎ সে দেখলে ঝকঝকে সোণার*২ পাকা সোণার মুদ্রা–প্রাচীনকালে বলা হত ‘সীনক’৷
সোণার পাহাড় দেখে কিপ্ঢেকঞ্জুসের চোখ ঝলসে গেল–ওঃ আমার জন্ম–জন্মান্তরের সাধ পূর্ণ হল৷ আমি আজ সবচেয়ে ধনী কিন্তু এই ধনরত্ন কী করে নিয়ে যাব কোথায় রাখব ........এই ধনরত্ন আমি সুদে আসলে আরও বাড়াব..........এতদিন জলখাবারে খেতুম তেল–নুন মাখা মুড়ির সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা৷ এবার থেকে কাঁচা লঙ্কা বাদ দিয়ে শুধু শুকনো মুড়ি খাব–খরচ কমাব......আয় বাড়াব৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্যাসাদ বাধল কীভাবে এই ধনকে নিয়ে যাওয়া যায় তাই নিয়ে ৷ ছ’টা পকেটে তো এই সোণার পাহাড় আঁটবে না৷ (ক্রমশঃ)
*১ (*তাম্রঞ্ছতাম্বঞ্ছতাম্ব্৷ প্রাচীন ভারতের পয়সা সাধারণতঃ তাঁবার হত৷ এই রীতি মোগলযুগ পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছিল৷ ইংরেজ যুগে পয়সা তৈরীতে খাঁটি তাঁবার ব্যবহার রহিত করে দেওয়া হয় কারণ তাতে পড়তা পড়ত না৷) পয়সার পাহাড়৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস ভাবলে........তাঁবার দাম কড়ির চেয়ে অনেক বেশী হলেও ছ’ পকেট ভর্ত্তি তাঁবার পয়সা নিয়ে গেলে তা এমন কিছু ক্ষড়লোকমির পরিচয় হবে না৷ তাই সে তাঁবার পাহাড় টপকে এগিয়ে চলল৷ আরও কিছুদূর গিয়ে দেখে–রূপোর টাকার* (*প্রাচীন ভারতে রূপোর টাকার প্রচলন ছিল৷ তবে মুদ্রা ছাপানো হত খুব কম৷ কিন্তু টাকাগুলো ছিল খাঁটি রূপোর৷ ইংরেজ যুগের গোড়ার দিকে কিছুদিন খাঁটি রূপোর টাকার ব্যবহার ছিল৷ তবে তাতে কিছুটা খাদ মেশানো হত৷ টাকার কতটা খাদ আছে তা হাতে বাজিয়ে শব্দ শুনেই ক্ষোঝা যেত৷ ব্যবহারযোগ্য রূপোকে বলা হত ‘চাঁদি’৷) (টংকক বা রৌপ্যকম্) পাহাড়৷
(*২ প্রাচীন ভারতে, পারস্যে ও এশিয়ার অধিকাংশ দেশে মুদ্রা তৈরী হত পাকা সোণার যার প্রচলিত সংস্কৃত নাম ছিল ‘কাঞ্চন’৷ ‘কাঞ্চন’ বলতে ক্ষোঝায় সেই সোণা যাতে তিলমাত্র খাদ নেই বা বিদূষণ ঘটেনি৷ খাদমেশানো সোণা বা গিনি সোণার উদ্ভব ইয়ূরোপে৷ ভারতে তা এসেছেন ইংরেজ আমলে৷)