‘‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’’

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর–

কিপ্ঢেকঞ্জুস ভাবলে–আরও এগিয়ে দেখি ...... দেখি সম্মুখে আরও কী রয়েছে৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলেছে–তিরবেগে তুরঙ্গের মত .......বল্গাবিহীন অশ্বের মত উল্কার গতিতে৷ কিছুদূর যাবার পর সে দেখে সামনে রয়েছে মণি–মুক্তা–মাণিক্যের পাহাড়৷  মণি–মাণিক্য* সে ভাবলে–এতদূর যখন এসেছি তখন আরও মূল্যবান কিছু পাওয়া যায় কিনা এগিয়ে দেখি৷.......এবার সে দৌড়ে দৌড়ে চলেছে ...........হাত–পা অবসন্ন, দম নিতে পারছে না৷ .......সর্বাঙ্গ দিয়ে কালঘাম ছুটছে.........তবুও সে ছুটে চলেছে.......ছুটে চলেছে .......এ চলার কি শেষ নেই

কিছুদূর গিয়ে সে দেখলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বেহ্মদত্যি (ব্রহ্মদৈত্য)৷ বেহ্মদত্যির মাথায় ঘুরে চলেছে সুতীক্ষ্ণ ফলাযুক্ত একটি প্রকাণ্ড চক্র৷ চক্রে তার মাথা কেটে মাথার ঘিলু বেরিয়ে আসছে ও ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে৷ বেহ্মদত্যি চীৎকার করে কাঁদছে৷ বলছে–‘‘গেলুম গো .....মলুম গো...... মা গো......কে কোথা আছো গো, বাঁচাও গো......আমি টাকা পয়সা চাই না....ধন দওলত চাই না.....আমি শান্তি চাই....আমি জীবনের পরম সম্পদ পরাশান্তি চাই৷’’ বেহ্মদত্যির মাথার রক্তবিন্দুগুলি চারিদিকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে৷ আর সেই রক্তবিন্দু যেখানেই পড়ছে সেখানেই তৈরী হচ্ছে এক একটি অর্থপিশাচ৷ তারা একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি মারামারি করছে..... তা করে নিজেরাই ধুলোয় লুটিয়ে পড়ছে.......তাদের অস্তিত্বের শেষ কণা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস বেহ্মদত্যিকে বললে–‘‘হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র ঘুরছে কেন?........ কেন এই অশেষভাবে ‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’?’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বেহ্মদত্যির মাথা ছেড়ে চক্রটা তার মাথায় আশ্রয় নিল৷ আর বোঁ বোঁ ..........বন বন করে ঘুরতে লাগল৷ যন্ত্রণায় কিপ্ঢেকঞ্জুস ডুকরে কেঁদে উঠল........আমি ধন–দওলত চাই না ..........আমি ভুল পথে চলেছিলুম..........আমি শিবের সিফারিশ মত কুবেরের সম্পদ চাই না.......আমি চাই শিবের শান্ত সমাহিত পরাপ্রশান্তি........কে, কোথা আছো গো, বাঁচাও গো..........মা গো, বাবা গো......গেলুম গো......মলুম গো.........আমাকে বাঁচাবার কেউ কোথাও কি নেই? আমি ছাই–মাখা শিবকেই চাই৷ 

বেহ্মদত্যি বললে–‘‘আমিও তোমার মত মোহগ্রস্ত অতিলোভী ছিলুম৷ তোমারই মত এইভাবে এইখানে এসে পৌঁছেছিলুম৷ এখানে এসে দেখেছিলুম আমারই মত আর এক ব্রহ্মপিশাচের মাথায় চক্র ঘুরছে৷ আমিও তাকে শুধিয়েছিলুম–হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র ঘুরছে কেন? শিবের ব্যবস্থায় বিধির বিধান হচ্ছে মোহের পরিণাম এই হয়....... ‘‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে৷’’ আবার যদি কখনও আমাদের মত কোনো মোহগ্রস্ত অতিলোভী লোক আসে আর জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র কেন ঘুরছে৷ সঙ্গে সঙ্গে চক্রটি তার মাথায় চলে যাবে আর তুমি চক্র–শাসন থেকে মুক্তি পাবে৷ আচ্ছা ভাই, তবে এখন আসি৷ কতদিন যে ‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’ অবস্থায় ছিলুম তার হিসেবনিকেশ নেই৷ তাই আমাকে এখন ফিরতে হবে৷’’

বেহ্মদত্যি আরও বললে–বেহ্মদত্যি হবার সময় যে বেল* (*মূল শব্দ হচ্ছে বিল্ব৷ বর্গীয় ‘ব’ দিয়ে লিখতেই হবে৷ পর্যায়বাচক শব্দ হচ্ছে ইক্ষবাকু, মহাফলম, শ্রীফলম৷ ‘বিল্’ শব্দের অর্থ ছিদ্র৷) গাছটিতে আশ্রয় নিয়েছিলুম এই দীর্ঘকাল পরে সেই গাছটি নিশ্চয়  মরে গেছে৷ তাই আস্তানা হিসেবে আবার নোতুন আর একটি বেলগাছের সন্ধান করতে হবে৷ শিবের কৃপায় আবার যখন তুমি মুক্তি পাবে, তখন আমার সেই বেলগাছটির তলায় এসো, আমি তোমাকে মই দিয়ে গাছে তুলে নোব৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস নিঃসঙ্গ অবস্থায় সেখানে দাঁড়িয়ে রইল৷ তার মাথা দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে৷ সেই রক্তবিন্দু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছিটকে পড়ছে৷ প্রতি বিন্দু রক্তকণা থেকে গজিয়ে উঠছে মোহবদ্ধ লোভী দানবের দল৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস চীৎকার করে কাঁদছে........মাগো.......বাবা গো.......গেলুম গো.......মলুম গো......‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’........৷

তাহলে মোহ রিপুর পরিণাম বুঝলে তো মুখ্যতঃ এই মোহ রিপু থেকেই ঘৃণা–ভয় প্রভৃতি পাশগুলির উদ্ভূতি৷ এখান থেকে  পরিত্রাণ পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে পরম পুরুষের ভাবনা নেওয়া৷ অন্য কোনো পথ নেই ....‘‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়’’৷


*মণি মানে যে–কোনো মূল্যবান রত্ন •gems and jewels— ৷ মাাণিক্য মানে মূল্যবান রক্তপ্রস্তর–বাংলায় চুনী, ইংরেজীতে রুবি•ruby—৷ মুক্তো–বাংলা ও সংস্কৃতে ‘মুক্তা’, হিন্দুস্তানীতে ‘মোতি’, ইংরেজীতে •pearl—¼ দিয়ে অনায়াসেই একটা সোণার পাহাড় কেনা যায়৷