চলুন, সুখী সমৃদ্ধ ত্রিপুরা গড়ে তুলি!

লেখক
জহরলাল সাহা

১০ই ডিসেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে  ত্রিপুরার   অন্যতম  দৈনিক  স্যন্দন পত্রিকায়  শ্রদ্ধেয় শম্ভূদেববর্মা ‘‘প্রসঙ্গ এন.আর.সি ও ত্রিপুরা’’  শিরোনামের প্রবন্ধটি সাম্প্রতিককালে একটি উৎকৃষ্ট সমালোচনামূলক  আলোচনা৷  এতে তিনি  সম্মানিত  হরিগোপাল  দেবনাথ, রঘুবীর দাস, জহরলাল সাহা, গৌরাঙ্গরুদ্র পাল, রঞ্জিত  বিশ্বাস,  শংকর দাশ, কপিল  তালুকদার, সংবাদ  প্রতিনিধি  ও জগদীশ  মন্ডল  মহাশয়গণের  লেখার  কিছু সমর্থক  ও কিছু  বিরোধিতা করেছেন৷ সমালোচনা  এক তরফা  হওয়া  উচিত  নয়৷  শ্রী দেববর্মার  গতি ছিল উভয় দিকেই৷ এটা  অবশ্যই  ধন্যবাদই৷

প্রথমেই  আমি মাননীয় শম্ভুবাবু যে যে  কথাগুলো  সমর্থন  করেছেন৷  তা হলো ---

১)  বাঙালীদের  দেওয়া  রাজস্বেই  বর্ত্তমান ত্রিপুরা গড়ে  উঠেছে৷ দাবি  আংশিক সত্য৷ কারণ  চাকলা রোশনাবাদ  সমতল  জমির  খাজনা  হিসাবে  রাজস্ব  আদায়  করা হতো৷  এটা  ছিল ত্রিপুরা রাজার  একটা আয়ের উৎস৷

২) ত্রিপুরার  রাজন্য  আমল  থেকে  বাঙালীদের  অবদান  অপরিসীম  বলে দাবী উঠে৷ দাবিটির  প্রতি একমত  ও  বাস্তবের  নিরিখে স্বীকার  করতে হয়৷

কারণ, রাজন্য আমলে, জনজাতিদের মধ্যে শিক্ষিতের  সংখ্যা ছিল খুবই  নগন্য৷  বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬) প্রথম  পূর্ববাংলা পরবর্ত্তীতে পূর্ব পাকিস্তান  অধুনা  বাংলাদেশ থেকে শিক্ষিত  বাঙালীদের  রাজ্যে  আনেন শিক্ষক হিসাবে  নিয়োগের  জন্য৷  কাজেই  জনজাতিদের  মধ্যে  শিক্ষা  বিস্তারের  জন্য  বাঙালীদের  অবদান অনস্বীকার্য৷

দুই, শুধু  শিক্ষা বিস্তারের জন্যই নয়  রাজকার্য বা রাজ্যশাসনের  প্রয়োজনে  দেখা দেয় শিক্ষিত  লোকের৷  তখন  পূর্ববঙ্গ  থেকে  শিক্ষিত লোক আনতে বাধ্য হন৷ তিন রাজ্যে  জনজাতিদের  মধ্যে কৃষি,  ব্যবসা-বাণিজ্য ধর্মপালন  ইত্যাদি  ক্ষেত্রেও বাঙালীদের  অবদান স্বীকার  করতেই হয়৷  যদি স্বীকার  না করে  তাহলে  বাস্তবকে  উপেক্ষা করার  শামিল৷

রাজন্য  আমলের  উল্লেখ্যযোগ্য  বাঙালী প্রশাসকরা  হলেন  নীলমণি দাস,  শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ কুমারগণের  শিক্ষার  জন্য  মহারাজা বীরচন্দ্র রাধারমণ  ঘোষকে  শিক্ষক নিযুক্ত করেন৷ ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে  উমাকান্ত দাস  শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন৷ পরে মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন  রায়বাহাদুর মোহিনীমোহন বর্ধন৷  বর্তমানে  উমাকান্ত  দাসের  নামানুসারে  উমাকান্ত  একাডেমী৷

৩) ১৯৪২ সালে ঢাকা জেলার  রাইপুরায়  সাম্প্রদায়িক  দাঙ্গা হয়৷  উদ্বাস্ত বাঙালীরা দলে দলে  ত্রিপুরা আসেন৷ মহারাজা বীরবিক্রম তাদের  সাদরে গ্রহণ  করেন ও  তাদের  থাকা খাওয়ার  ব্যবস্থা করেন৷  শুধু তাই নয়,  শহরতলীর  অরুন্ধতী নগরে  কলোনি  স্থাপন  করে  তাদের  পুনর্বাসনও দেন৷ ১৯৪৬ সনে  নোয়াখালির  সাম্প্রদায়িক  দাঙ্গায়  ক্ষতিগ্রস্থ ও আতঙ্কগ্রস্থ  বাঙালি  দলে দলে  উদ্বাস্তু  হয়ে ত্রিপুরায়  এলে  মহারাজা তাদেরও গ্রহণ ও আশ্রয়  দান  করেন৷  বাঙালীদের  প্রতি  ত্রিপুরার  মহারাজাদের  অবদান সম্পর্কে  বর্তমানে  কতজন  জানে  ও তাদের  অবদান  কি অস্বীকার  করা যায়?

এটাতো  ঠিক  ত্রিপুরার ইতিহাস কতজন জানে?  তবে  মহারাজাদের  অবদান  কেউ বা কোন বাঙালী অস্বীকার করে না করতে  পারে না৷  বাঙালী বিজ্ঞানী  আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র  বসুর  ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ গড়ার  জন্য ত্রিপুরার রাজার অবদান সবাই  শ্রদ্ধার  সঙ্গে  স্মরণ  করে৷  বাঙালী কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে  প্রথম ‘‘ ভারত ভাস্বর’’ উপাধিতে  সম্মানিত  করেন ত্রিপুরার রাজাই৷ পরে তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল  পুরস্কার  পেয়ে  বিশ্বকবি  হন৷

রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরার জন্য  কম  করেননি৷  তিনি নীরমহল, উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ, মালঞ্চ নিবাস ইত্যাদির  নামাকরণ  করেন৷ ত্রিপুরার রাজবাড়ীর ইতিহাস নিয়ে  মুকুট, রাজর্ষি, বিসর্জন ইত্যাদি নাটক ও উপন্যাস  লিখে  ত্রিপুরাকে বিশ্বের  দরবারে  তুলে ধরেন৷  তাঁর ‘‘কেন  যামিনী না যেতে  জাগালে  না’’ সঙ্গীতটিও  ত্রিপুরায় বসেই  লেখা৷ তাঁর  লেখা ‘‘ভগ্ণ-হৃদয়’’ কাব্য পড়ে  মহারাজ  বীরচন্দ্র  উৎসাহিত  হন  ও কবিকে  অভিনন্দন জ্ঞাপন  করেন৷

মাননীয় শম্ভু দেববর্মা  কিছু  জনগণনার  পরিসংখ্যান তুলে  ধরেছেন৷ তাতে  সব ক্ষেত্রে  হিন্দু বাঙালীদের  সংখ্যা দেখাননি৷ কথা হচ্ছে  জনজাতি ST)  ও  অন্যান্যদের সম্পর্কে৷ কারণ জেলাপরিষদ, ষষ্ঠ তপশীল  ইত্যাদি তো  জনজাতি  (বাST) দের জন্যে ৷ ধর্মমতের  ভিত্তিতে  জনসংখ্যার  বিভাজন  আলোচ্য বিষয় নয়৷ সে সময়কার  ত্রিপুরার  মুসলমানরা  ও তো বাঙালী৷  মণিপুরীরা  জনজাতি  নয় (বাST নয়)৷ তাহলে  প্রকৃত হিসাবে  দেখবেন ত্রিপুরায়  সর্বকালে Non ST -রা বিশেষতঃ  বাঙালীদেরই  মোট  জনসংখ্যার  অর্ধেকের বেশী বা  সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ ত্রিপুরায়  এমনও  অনেক  বাঙালী বসতি আছে যা আগেও  ত্রিপুরা   বা ভারতে  ছিল  আজও  আছে৷ যথা- ১) শেখেরকোর্টের  পশ্চিমে কুলতলী, গাবতলা, রায়ের  মুড়া  ইত্যাদি৷

২) ত্রিপুরা  বাঙালীর অঞ্চলের ৯০ শতাংশ  পোর্টের মধ্যে৷ তাই  এখানে  বাঙালীদের  বসবাস সুপ্রাচীন৷  এখনকার  মতো  আগে কাঁটা তারের  বেড়া  ছিল না৷  ত্রিপুরা  যখন  একটি  জেলা ছিল  তখনকার ১০টি  মহকুমা  সদরে  বাঙালীদের  রায় অতিপুরানো৷

৩) চাকলা  রোশনাবাদ ছিল ত্রিপুরার রাজার  জমিদারী৷ সেখানকার  রাজস্ব (কর) দাতা  বাঙালীরা  প্রয়োজনে  ত্রিপুরায় এসে  বসবাস  শুরু  করে৷

এবারে  শ্রীদেববর্মা মহাশয়ের  কিছু  বক্তব্যের  সত্যতা  নিয়ে  প্রশ্ণ জাগে৷ যথা---

১)ত্রিপুরার উপজাতিরা/ জনজাতিরা ৫ হাজার  বছর ধরে  ত্রিপুরায় বাস করছে৷  যদি  তা সত্য  হয়  তবে প্রশ্ণ--- এ সময়ে  ও তারা  কেন জাতিতে  উন্নিত  হতে  পারল না?  ত্রিপুরার উপজাতিরা মোট  ১৯টি গোষ্ঠী৷  তাদের  মধ্যে সাঁওতাল  মুন্ডা--- ওঁরা ও ছত্তিশগড়,  ঝাড়খণ্ড  ইত্যাদি  স্থান থেকে এসেছে চা- বাগান নির্মান কাজ, ইটভাটা ইত্যাদির শ্রমিক  হিসাবে৷ তাও বীরচন্দ্র মাণিক্যের সময়  ত্রিপুরায় যখন আধুনিকতার  সূচনা  হয়৷  তাও  দেড়শত  বছরের বেশী নয়৷  পাশ্ববর্তী রাজ্য থেকে  যেমন--- সিকিম  থেকে লেপচা, ভুটান থেকে ভুটিয়া, মেঘালয় থেকে খাসিয়া,  মিজোরাম থেকে লুসাইরা ত্রিপুরা আসে৷ সেও ১০০/১৫০ বছরের  বেশী হবে না৷  পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে  আসে  বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা, মগরা৷ কুমিল্লার লালমাই পাহাড়  এলাকা থেকে আসে  নোয়াতিয়া  ইত্যাদি  আর শ্রীহট্টের  চা বাগান বা পাহাড়  অঞ্চল থেকে  আসে  গারো  প্রভৃতিরা৷  আর রইল বাকী কক-বরক ভাষী ত্রিপুরী, জমাতিয়া, রিয়ারা৷  তবে  তাদের মধ্যে  ভাষা, উচ্চারণ শৈলী, গোষ্ঠীগত  কৃষ্টিতে কমবেশী প্রভেদ  রয়েছে৷  শোণা যায় এরা  ৫৫০ বৎসর  আগে ব্রহ্মদেশের (অধুনা মায়ানমারের) আরাকান, শান ইত্যাদি অঞ্চল থেকে জিবীকা ও খাদ্যের  জন্য ত্রিপুরায় আসে৷  ওদের রাজাদের  গতিপথ ছিল  বিলোনীয়ার রাজনগর, উদয়পুরের রাঙ্গামাটি,  অমরপুর  খয়েরপুর  ও শেষে  আগরতলা৷

ত্রিপুরার ইতিহাসের  উপাদান বলতে ১৪৬৪ সালের  রত্ন মাণিক্যের আমলের  একটি মুদ্রা পাওয়া যায়৷  ১৫০১ সালে  ধন্যমাণিক্য রাঙামাটি  বর্তমান উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরীর  মন্দির  নির্মান করেন৷

কিন্তু উনকোটির  শিলা  মূর্ত্তিগুলি  ও পিলাকের দেবদেবীর  মূর্ত্তিগুলি  ত্রিপুরার  রাজারা তৈরী করেন এমন  কোন প্রমান পাওয়া  যায় না৷  মহারাজা ধর্মমাণিক্যের (১৪৩১-৬২) সময়  রচয়িতা/ সংকলক/ সম্পাদক  দুর্লভেন্দ্র শুক্রশ্বর ও বানেশ্বরদের  দিয়ে ‘‘রাজমালা’’ প্রথমখণ্ড রচনা করান৷ তাই  পঞ্চদশ শতকের  আগের ত্রিপুরার ইতিহাস  কিংবদন্তির  আড়ালে৷ কিংবদন্তি কোন ইতিহাস হতে পারে না৷

তবে দুঃখের  বিষয়  ত্রিপুরার ইতিহাস বিকৃত  হতে শুরু  করে ১৯৭৮ সাল অর্থাৎ কম্যুনিষ্টদের  রাজত্ব থেকে৷ ভারতে  আভ্যন্তরী জরুরী অবস্থায়  বাড়াবাড়িতে  এন্টি কংগ্রেস সেন্টিমেন্টে ১৯৭৮ সালে  ত্রিপুরা বিধানসভায়  ৫৬টি আসন নিয়ে  কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতায় আসে৷ আর বাকী চারটি  পায়  যুবসমিতি৷ কম্যুনিষ্টদের মনে  ১৯৪৯-৫১ সালের ‘বাঙলা খেদা’ আন্দোলনের  কথা  মনে পড়ে৷ কম্যুনিষ্টমুক্তাঞ্চল গড়ার’’ এইতো সময়৷  মুখে  শ্লোগান ছিল৷  ‘‘গরীবের বন্ধু সরকার৷’’ ত্রিপুরার আপামর জনগণ সহজ সরল মন নিয়ে  ওদের  বিশ্বাস করে৷  ওরা  বাঙালীদের  শোষক আখ্যা দিয়ে  সরকারী পেট্রোল ডিজেল পুড়ে  এন্টি বেঙ্গলী জনমত গড়তে  থাকে৷  আর  উপজাতিদের  সরল মনকে  নানা আষাঢ়ে গল্প  ফেঁদে ‘বাঙালী বিরোধী’ করতে থাকে৷  গঠন  করে ৭ম তপশীল  অনুযায়ী উপজাতি  জেলা পরিষদ, তারপর ১৯৮০ সালের  গণহত্যা৷ তার  উপর কংগ্রেস  সংবিধান  সংশোধন  করে ৬ষ্ঠ তপশীল প্রয়োগ  করে মিশ্র বসতি ত্রিপুরায়৷  একটা স্থায়ী বিভেদ অবিশ্বাসের  প্রাচীর  গড়ে তোলে৷ তাই  ত্রিপুরার চরম সর্বনাশের জন্য  দায়ী কম্যুনিষ্টরা৷ তাই তো  দীর্ঘ ৩৫/৪০ বছরের  এন্টিকম্যুনিষ্ট সেন্টিমেন্টে ২০১৮ সালে  বিজেপি-আই.পি.এফ.টি জোট ৪৬টি আসনে  জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসে৷

১৯৪৯ সালে  ত্রিপুরা ভারতে  যোগ দেবার সময় মাত্র ১০৯ কিমি পাকা রাস্তা ছিল৷ তার আগে  ত্রিপুরার রাজা আগরতলা থেকে উদয়পুর  যেতে হলে--- আগরতলা থেকে  আখাউড়া রেল ষ্টেশন৷ রেলে  কুমিল্লা  গিয়ে  গোমতী নদী দিয়ে  নৌকায়  উদয়পুর যেতেন৷ সে  ত্রিপুরা ১৯৫২-৫৭ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায়  আগরতলা-ধর্মনগর (আসাম-আগরতলা রোড) ও দক্ষিণদিকে  আগরতলা  থেকে সাব্রুম রোড তৈরী হয়৷  তারপর ১০টি  মহকুমা সদরকে  ওই দুই  রাজপথের  সাথে  যুক্ত করা হয়৷ উত্তরদিকে তেলিয়ামুড়া, আমবাসা,  মনু, কুমারঘাট  পেঁচারথল, পানিসাগর  ইত্যাদি  সমৃদ্ধ  বাজারগুলি  গড়ে উঠে৷ আর দক্ষিণে বিশ্রামগঞ্জ, শান্তির  বাজার  ইত্যাদি বাজারগুলিও সৃষ্টি হয়৷  যাদের  অনেকগুলি  আজ শহরে  পরিণত  হয়েছে৷ ১৯৫২-৭৭ এই ২৫বছরে  মিশ্রবসতির  ত্রিপুরা বাহ্যিক  ও আন্তরিকভাবে  অনেকটা এগিয়ে  যাচ্ছিল৷ কিন্তু কম্যুনিষ্টরা  রাজনৈতিক  আষাঢ়ে গল্পে ১৯৭৮-২০১৮ এই ৪০ বছরে  বাহ্যিক প্রগতি অবিশ্বাস্যের  প্রাচীর  খাড়া  হয়ে গেছে৷  দায়ী কে?  দায়ী সি.পি.এম অর্থাৎ কম্যুনিষ্টরা৷

ছোট এ প্রতিবেদনে বিশেষ  বলার  সুযোগ  কম৷  তবুও  একান্ত  নিজের  অভিজ্ঞতায় ত্রিপুরার সরল প্রাণ উপজাতিদের আতিথিয়তার কিছু ব্যষ্টিগত প্রমাণ দিতে চাই৷ ১৯৬৫ সালে সদর বি ইন্সেপেক্টরের  অধীন  দক্ষিণ পূর্ব সার্কেলের  অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকের এক্তিয়ারে আমি  শিক্ষকতার চাকুরী  পাই৷  অফিসটা ছিল বিশালগড়  টাউন জে.বি.স্কুলে৷ আমি বিশালগড় গোলাঘাঁটি টাকার জলা---জমপুইজলা পার হয়ে হেঁটে প্রায় ৪০ কিমি দূরে  চাম্পাশর্র্ম জে.বি.স্কুলে এক শিক্ষক বিদ্যালয়ে  চেয়ারম্যান শ্রী বুদ্ধিচন্দ্র কলইয়ের কাছ থেকে  চার্জ নিয়ে ক্লাশ থ্রী পর্য্যন্ত ১৬জন ছাত্রের শিক্ষক হই৷ এ বিদ্যালয়ের  শিক্ষক কাঁকড়াবন বৈসিক ট্রেনিং কলেজে এক বছরের  জন্য ট্রেনিংয়ে যান৷  আমি তাঁরই সাবষ্টিটিউট শিক্ষক৷ চাকুরী পাবার তিন মাস পর  বেতন পাই৷  এতদিন শ্রী পবিত্র কলইয়ের বাড়ীতে খাই, থাকি৷ তিন মাস পর  বেতন  পেলে  পবিত্র বাবু  শুধু চার্ডলের  দাম মাত্র ২০ টাকা আমার কাছ থেকে নেন৷

গ্রামের  লোকেরা আমার জন্য  ঘর  তুলে দেয়, চৌকি, বালিশ, ডেক কড়াইয়ের  ব্যবস্থাও  করে দেন৷  শুনা  যায়  এক শিক্ষক  স্কুলের  শিক্ষকরা  মাপে তিনদিন স্কুলে যায় আর ২৭ দিন বাড়ীতে  থাকে৷  আমি  অফিসের  কাজ বেতন  তোলা  ও বাড়ীতে  বাজার হাট  করে দেওয়া  নিয়ে  তিন দিন  স্কুল  বন্ধ  বা ষ্টেশন লিভ্  করতাম আর বাকী ২৭ দিন স্কুল করতাম ও ষ্টেশনে থাকতাম৷

ছাত্রদের সাথে  বিকালে  খেলাধূলা, শরীরচর্চা করতাম৷ যখন  আমি বদলী  হই--- ছাত্র/ছাত্রারা কেউ একঘটি দুধ,  কেউ  একটা পাকা  পেঁপে, কেউ ৮/১০ টা পাকা  সবরী কলা ইত্যাদি আমার  জন্য  নিয়ে এলো আনন্দে  আমার  চোখে  জল  আসার ব্যাপার ৷ আমি  কি করব  এসব নিয়ে৷ প্রত্যেকের  আনা আদরের  শ্রদ্ধার  জিনিষটা আমি  গ্রহণ করি  ও একের  জিনিস অন্যকে  দিয়ে দিই৷ আর  গ্রামবাসী ব্যাণ্ড পার্টি  বাজিয়ে  অনেকটাই  এগিয়ে দেয়৷ ৫ কিমি দূরে  দারকাইছড়া  স্কুলে ২ জন গ্রামবাসী আমার  লাগেজসহ  আমাকে  পৌঁছিয়ে  দেয়৷  জানিনা  এমন  বিদায়  সম্বর্ধনা অন্য কেউ  পেয়েছে  কি না?

১৯৬৬ সালে  দারকাইছড়া জেবিস্কুলে ছাত্র/ছাত্রা জনা চল্লিশেক৷ ক্লাসফাইভ পর্য্যন্ত৷  থাকতাম শ্রী শুকরাম  দেববর্মা বাড়ী৷ তিনি আমাকে  নিজের  ছোট ভাইয়ের মত দেখতেন৷  এটাও ছিল সিঙ্গল টিচার স্কুল৷ তাঁদের আতেথিয়তার কথা আজও ভুলতে  পারিনা৷

 এবছরেরই  শেষের দিকে তেলিয়ামুড়া ব্রহ্মছড়া নিভু বিদ্যালয়ে  বদলী  হয়ে  আমি ক্লাশ ওয়ান থেকে ক্লাশ ফাইভ পর্য্যন্ত ১৪০ জনের উপর  ছাত্র৷ মিশ্র বসতি এলাকা৷ ওই সিঙ্গল টিচার স্কুল৷ আমার বাড়ী থেকে ৫ কিমি  দূরে পায়ে  হেঁটে গিয়ে  একদিন সকালে  পথে  বাঘ  দেখতে পাই৷ তারপর  স্কুলটাকে  দুপুরে করে নিই৷ সেখানকার ছাত্ররা এখন ঠাকুর দাদা হয়ে গেছে৷ তবুও ওরা  দেখা হলে  পায়ে  পড়ে নমস্কার করে৷ আদর করে বলে স্যার! কেমন  আছেন? এরপর একটা দ্বাদশশ্রেণী বিদ্যালয়ে  বদলী হয়ে যাই৷ সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করি৷

আমার শিক্ষক জীবনের স্কুলগুলিতে গিয়ে সমীক্ষা করা যেতে পারে৷ আমি একজন মানবতাবাদী মানুষ৷ আমার কাছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান সবাই  সমান৷ সকলেই দেবশিশু (Divine Child) আমার লেখাগুলোতে  কোথাও উপজাতি  সাধারণের  বিরুদ্ধে  নেই৷  বরং কম্যুনিষ্ট নেতাদের বানানো আইন  কংগ্রেসের, বিজেপি নেতাদের আইনী পদক্ষেপ  নিয়েই  আমার সব বক্তব্য৷ চলুন, ত্রিপুরার সকলের  স্বার্থে ১৯৭৭ সনের আগের  পরিবেশ আমরা ত্রিপুরার ফিরিয়ে আনি৷ তাতে সবার  কল্যাণ হবে৷  নইলে, ওই পুরানে কথা গাঁয়ে আগুন  লাগলে  দেবালয় ও বাঁচবে না৷

ত্রিপুরার আসল  সমস্যা অর্থনৈতিক৷ সমস্যা কর্মসংস্থান, ক্রয়ক্ষমতা ও সকলের  পারিবারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য৷ এখানে কার কি ধর্মীয় মতবাদের কে কোন রক্তের, কোন ভাষার--- এটা  বিষয় নয়৷  মিলন---মিশ্রণের  মাধ্যমে রক্তের সংমিশ্রন ঘটে৷ তাতে উন্নত দেহ, উন্নত মন (বুদ্ধি) সম্পন্ন মানুষ তৈরী  হয়৷ তাতেই সমাজের  সকলের কল্যাণ হবে৷ সুখী সমৃদ্ধ ত্রিপুরা গড়ে উঠবে৷ আর কি?