যে যাই বলুক ও চিন্তা করুক যা বাস্তব সত্য তা হলো মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী৷ এই কারণেই প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজবেত্তাগণ ‘সংগচ্ছধবং’ মন্ত্রকে চলার পথে ধ্রুবতারা বলেই মান্যতা দিয়েছেন৷
এই ‘সংগচ্ছধবং’ হলো গণতন্ত্রের সাফল্যের চাবিকাঠি৷ এই চাবিকাঠিকে ফেলে যারা ছল-বল-কৌশলে সেই মানবসমাজের ঐক্য সংহতিকে ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে তারা কেউই কোনদিন সার্থক হয় না৷ মানুষকে ধরে রাখার জন্য যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন সেটা হলো বিশ্বৈকতাবোধকে জাগ্রত করা৷ বিশ্বৈকতাবোধ জাগ্রত হবে তখন যখন মানুষ অন্তরের সঙ্গে বুঝবে যে তাঁদের উৎস সেই এক অদ্বিতীয় পরমপিতা (পরমব্রহ্ম)৷ আমরা সবাই নরনারী নির্বিশেষে তাঁরই সৃষ্ট৷ যখন এই আত্মিক সম্পর্ককে সকলে অন্তরের সঙ্গে মেনে নিতে পারবো তখনই আমরা মানুষরা এক মানব সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব৷ এটাও চরম সত্য তা হলো পৃথিবীর সৃষ্ট সবকিছুই হলো সেই পরম পিতারই সৃষ্টি৷ তাই আমরা সবাইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতযোগে বিধৃত৷ এটাই হলো বৈচিত্রময় জগতের ঐক্যের সুর৷ একই চন্দ্র-সূর্য্য একই বাতাস একই এই ধরণী, জল ,আবহাওয়া আমাদের বেঁচে থাকার পথে সেবা দিয়ে চলেছে৷ সবের মূলে সেই বিরাটের শুভ ইচ্ছাশক্তিকে কাজ করে চলেছে৷ তাইতো বলা হয়, তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হবার নয়৷ এটা আপেক্ষিক জগতে সোজাভাবে মেনে নিতে বহু দ্বিধা ও বহু প্রশ্ণ এসে যায় মানুষের মনে৷ এখানেই হয় নানা গণ্ডগোল৷ আজ কিন্তু ভৌতবিজ্ঞানের উন্নতিতে আমরা উপলদ্ধি করছি যে সারা পৃথিবী আজ একটা বড়ো পরিবারের মতোই৷ আজ একদেশে দুর্র্যেগ দেখা দিল অন্য দেশের ভাই বোনেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করে৷ অন্তরের ব্যাকুলতা আশা আকাংক্ষা সব মানুষের একই৷ সকল মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে স্নেহ মমতা এই শুভগুণগুলি৷ তাই আমরা শুভের কল্যাণের চিন্তা করেই বাঁচবো আর অন্যকে বাঁচতে দেব৷ বাহিরে আপাতদৃষ্টিতে শুধু ভেদাভেদ ভিতরে সবই এক৷ এই আধ্যাত্মিক উপলব্ধি হলো আমাদের মিলনের একমাত্র পথ৷ তাই এই আধ্যাত্মিকতার মন্ত্রে আমাদের দীক্ষিত হয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে৷ এ কাজের একটি মাত্র পথ আছে আত্মবিশ্বাসে ভর করে সেই পরম স্রষ্টাকে পথপ্রদর্শক হিসাবে মেনে নিয়ে ভক্তির ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাইয়ের সাথে মিলেমিশে একই সাথে এগিয়ে চলা৷ এ পথে নিজেকে জানতে হবে, আত্মজ্ঞানের সন্ধান করতে হবে৷ এরজন্য আধ্যাত্মিক সাধনা করে যেতে হবে৷ আর নারায়ণজ্ঞানে জীবের সেবা করে যেতে হবে৷ এই বিশ্ব সংসারের স্রষ্টা যিনি তাকে আনন্দ দেওয়ার ব্রত হলো ভক্তি৷ এটি হবে তাঁর ওপর বিশ্বাস রেখে বৃহৎ ভাবনায় ভাবিত হয়ে চলা৷
এ বিশ্বের সবাই বা সবকিছু যখন ব্রহ্মের বিকাশ, তাই মানুষ সবাইকে ভালবাসবে৷ ব্রহ্মের বিকাশ হিসেবে সবার সেবায় আত্মনিয়োগ করবে৷
কিন্তু আজ মানুষ ধর্মের বাণীকে বিকৃত করে ধর্মের নামে জাত -পাত -সম্প্রদায় ভেদ সৃষ্টি করে মানবসমাজের ঐক্য নষ্ট করেছে৷ আমাদের বুঝতে হবে একপিতার পাঁচ সন্তান হলে, সন্তানদের পৃথকজাত বা সম্প্রদায় হতে পারে না৷ তাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, পারস্পরিক ঘৃণা, সংঘর্ষ কোনোদিন ধর্মের পথ হতে পারে না৷
মানুষ বর্তমানে প্রকৃত ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতাকে ভুলে ধর্মকে আপন আপন সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চাইছে৷ ধর্মকে বিকৃত করে মানবসমাজকে ধবংসের পথে ঠেলে দিয়েছে৷
তাই বিংশ শতাব্দীতে জগদ্গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূত্তির্জী ধর্ম সম্পর্কে মানুষের সমস্ত বিভ্রান্তি ও ভুল ধারনা দূর করে প্রকৃত ধর্মের পথের সন্ধান দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, সকল মানুষই এক পরমপিতার সন্তান তাই সমস্ত মানুষ এক পরিবারের সদস্যেরই মত৷
তিনি বলেছেন, মানুষের আদর্শ হ’ল---‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ অর্র্থৎ অন্তর্জগতে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মোন্নতি ঘটিয়ে অণুর সঙ্গে ভূমার মিলন--- ব্রহ্মসম্প্রাপ্তি৷ আর, সামাজিক ক্ষেত্রে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা৷ এক আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা৷ যাতে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়--- তার জন্যে সবাই মিলিত প্রচেষ্টায় এক উপযুক্ত সামাজিক -অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলুক৷ সেই পথই তিনি দেখিয়েছেন তাঁর যুগান্তকারী ‘প্রাউট’ দর্শনের মাধ্যমে৷ এই প্রাউটের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বিশ্বের সমস্ত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে৷ এটাই আধ্যাত্মিক নবজাগরণের পথ৷ আজ এই আধ্যাত্মিক নবজাগরণের মাধ্যমেই ছিন্ন ভিন্ন সমাজকে একসূত্রে গেঁথে বিশ্বমানবতার সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে৷
- Log in to post comments