দান খয়রাত নয়, ক্রয় ক্ষমতা দান

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মহান্ দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘প্রাউট’ দর্শনে বলা হয়েছে, সমাজের প্রতিটি মানুষের যা সর্বনিম্ন প্রয়োজন অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারান্টী দেওয়া সবাইকার জন্যে করাই যে কোনো কল্যাণকামী সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য৷ তার মানে  কিন্তু সরাসরি প্রত্যেকের গৃহে অন্ন পৌঁছিয়ে দেওয়া বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছিয়ে দেওয়া সরকারের কর্তব্য নয়৷ আর তা করাটাও সমাজের পক্ষে ভাল নয়৷ প্রাউটে বলাই হয়েছে, প্রতিটি মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব সমাজের বা সরকারের৷ কিন্তু সরকার যদি এই দায়িত্বের প্রেরণায় প্রেষিত হয়ে প্রত্যেকের গৃহে অন্নপ্রেরণের ব্যবস্থা করে’ প্রত্যেকের জন্যে গৃহ নির্র্মণ করিয়ে দেয় সেক্ষেত্রে ব্যষ্টির কর্ম প্রচেষ্টায় ভাঁটা পড়তে পারে--- সে ক্রমশঃ অলস হয়ে যেতে পারে৷ তাই সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাতে গেলে তারজন্যে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, নিজ সামর্থ্যমত পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষ যাতে সেই অর্থ উপার্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থাই সরকারকে করতে হবে৷ মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজনের মানোনয়ন করতে গেলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়াই হবে তার উৎকৃষ্ট উপায়৷

 বলাবাহুল্য, গত ২২শে নবেম্বর মাদ্রাজ হাইকোর্টের একটি রায় প্রাউটের এই যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তকেই সমর্থন জানিয়েছে৷ মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি এন কিরুবাকরণ ও বিচারপতি আব্দুস কুদ্দো দেশের রেশন কার্ডধারীদের বিনামূল্যে চাল প্রকল্প (পি.ডি.এস)-এর বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি রায়ে বলেন, দল অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বহু মানুষকে এই ধরণের সুবিধা পাইয়ে দেন, কিন্তু তার ফলে ওইসব মানুষের সরকারের প্রতি প্রত্যাশা অমূলকভাবে আরও বাড়ছেও তারা অলস হয়ে যাচ্ছেন৷ হাইকোর্টের বক্তব্য, এই রেওয়াজ বন্ধ করে শুধুমাত্র বিপিএল তালিকাভুক্তদের চাল বরাদ্দ করা উচিত৷

বর্তমানে যাদের অন্নাভাব নেই, তাদেরও এই বিনে পয়সার চাল বা ২ টাকা কিলো চাল দেওয়া হচ্ছে৷ আর, দেখা যায় তাঁরা প্রায় কেউই সরকারের দেওয়া এই চাল নিজেরা খান না বাজারে বিক্রি করে দেন৷ শহরে গ্রামে সর্বত্রই এই জিনিসটা দেখা যাচ্ছে৷ এতে সরকারী অর্থের অর্থাৎ প্রকৃত পক্ষে জনগণের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে৷

তাছাড়া জনগণের দারিদ্র্য দূর করতে বা অনাহার মৃত্যু ঠেকাতে এই খাদ্য সুরক্ষা কর্মসূচী একান্ত প্রয়োজন বলে যাঁরা যুক্তি দেখান, তাদের উত্তরে বলতে হয়, মানুষের  কেবল চালের অভাব নয়, অভাব সব দিক থেকেই ৷ তাই কেবল বিনে পয়সায় বা সস্তায়  চালের জোগান দিলেই তাদের অভাব মিটে যায় না৷ আর অন্নের কথা বললেও কেবল ভাত খেলে মানুষের পুষ্টি আসে না , তার সঙ্গে সঙ্গে প্রোটিন , ভিটামিনও চাই৷ নাহলে অপুষ্টি জনিত রোগে মানুষকে মরতে হবে৷ অপুষ্টিজনিত মৃত্যু কার্যত অনাহার মৃত্যুরই সামিল৷

তাই সরকারের কর্তব্য কী? মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা৷ মানুষ যাতে সাধ্যমত পরিশ্রম করে’ প্রয়োজনীয় অর্থ রোজগার করতে পারে, যে অর্থে যাতে তার অন্ততঃ নিম্নতম প্রয়োজন মিটবে--- তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ সেই ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে৷ সেটাই উন্নয়নের প্রথম কথা৷ তা না করে বড় ড় বিল্ডিং, বড় বড় আধুনিক হৎ শিল্প গড়ে তুললেই দেশের উন্নয়ন হয় না৷ দেশী বিদেশী পুজিঁপতিদের ধরে এনে কিছু বৃহৎ শিল্প গড়ে তুললেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না৷ পশ্চিম বাংলায় হুগলি-হাওড়া জেলায় অবস্থিত বহু হৎ শিল্প থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের চা বাগান পর্যন্ত কত যে মালিকের হঠকারী সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়েছে আর তার জন্যে কত মানুষের জীবনে ও পরিবারে যে অন্ধকার নেমে এসেছে , কত মানুষের যে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে তার হিসেব কজন রাখে?

তাই যেখানে ‘সারপ্লাস লেবার’ অর্থাৎ কর্মহীনতা যেখানে মূল সমস্যা সেখানে ‘লেবার ইনটেনসিব্ ইনডাষ্ট্রি’ অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যাপকভাবে গড়তে হবে৷ আর তার জন্যে বাইরে থেকে বড় বড় পুজিঁপতি দের ডাকিয়ে আনতে হবে না৷ রাজ্যের সাধারণ মানুষের ব্যষ্টিগত উদ্যোগে বা সামূহিক উদ্যোগে (সমবায়) কে কে ব্যাপক শিল্পায়নই কোর সমস্যার সমাধানের প্রকৃষ্ট উপায়৷ এজন্যে উপযুক্ত ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা করে ব্যাপকভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি-সহায়ক শিল্প গড়তে হবে৷ তার পাশাপাশি অবশ্য অকৃষি শিল্পও গড়ে তুলতে হবে৷ যেখানে যে কাঁচামাল সহজপ্রাপ্য সেই কাঁচামালের সর্বাধিক উপযোগ ঘটিয়ে শিল্প গড়ে তোলার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে’ তাকে বাস্তবায়িত করবার কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে৷ সেইভাবে মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ও তাদের সাহায্য করতে হবে৷ কৃষি ও কর্ষকদের সমস্যারও বিজ্ঞনসম্মত সমাধানের ব্যবস্থা  করতে হবে৷

না হলে কেবল দান খয়রাত করে সস্তায় নাম কেনবার চিন্তা করলে দেশের যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব নয়৷

রাজ্যের বিশেষ কিছু নির্দিষ্ট স্থানে শিল্প না গড়ে তুলে সমস্ত জেলাগুলিতেই সেখানকার স্থানীয় কৃষিজাত কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তবেই গরীব সাধারণ মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের দরজা খুলে যাবে৷ সরকার দান খয়রাত করে যে অর্থ ব্যয় করেন তা পরিকল্পিত ভাবে ব্যয় করলে জনগণের বেশি কল্যাণ করা যাবে৷