দধীচি দিবস কেন?

লেখক
প্রভাত খাঁ

পুরাণের গল্পগুলো খুবই শিক্ষনীয়৷ আসুরিক শক্তির বিনাশে দধীচি মুনির আত্মত্যাগ সেরকমই এক শিক্ষনীয় কাহিনী৷ পুরাণ বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী বৃত্তাসুর নামের এক অসুর স্বর্গরাজ্য জয় করে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ণ করে৷ নিরুপায় দেবতারা বিষ্ণুর কাছে স্বর্গ উদ্ধারে সাহায্য প্রার্থনা করেন৷ দেবতাদের কাতর আবেদন শুণে বিষ্ণু বলেন---কেউ স্বেচ্ছায় জীবন দান করলে তার অস্থি নির্মিত বজ্রের সাহায্যে বৃত্তাসুর কে বধ করা সম্ভব হবে৷

নিরুপায় দেবতারা দধীচি মুনির সরণাপন্ন হলেন৷ সবশুণে বৃহতের স্বার্থে দধিচী মুনি স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ করলেন৷ তাঁর অস্থি নির্মিত ব্রজের সাহায্যে বৃত্তাসুরকে বোধ করে দেবতারা স্বর্গ রাজ্য উদ্ধার করে৷ পুরাণের এই কাহিনীতে বৃত্তাসুর অশুভ শক্তির প্রতীক৷ সমাজ থেকে অশুভ শক্তিকে নির্মুল করতে হলে কিছু সৎনীতিবাদী মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে৷ পুরাণ বর্ণিত এই কাহিনীর নির্যাস এটাই৷

আজ সমগ্র মানব সমাজটাই বৃত্তাসুরদের দখলে চলে গেছে৷ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে চরম অবক্ষয়৷ ধর্ম, সমাজনীতি, অর্থনীতি,রাজনীতি মানব সমাজের প্রগতির সর্বক্ষেত্র দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে৷ পুঁজিবাদী শোষণের জাল সর্বত্র বিস্তারিত৷ ধনীর ভাণ্ডারে পার্থিব সম্পদের সিংহভাগ জমা হয়ে উঠছে৷ অপরদিকে কোটি কোটি মানুষ চরম অভাবে শুকিয়ে মরছে৷

মানব সমাজের এই চরম দুঃসময়েই আবির্ভূত হলেন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ আদর্শ মানবসমাজ ঘটন করতে দিলেন এক সর্বানুসূত জীবন দর্শন৷ যে দর্শনে আছে ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে সু-স্পষ্ট পথনির্দেশনা৷ এই দর্শনকে মানব সমাজে ছড়িয়ে দিতে, হিংসা বিদ্বেষ স্বার্থের সংঘাত ভুলে মানব সমাজকে এই মহান আদর্শের পথে এনে সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়তে গড়ে তুললেন আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ৷ সাধনা সেবা ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে তুললেন সর্বত্যাগী কর্মীদল৷ কর্মক্ষেত্র গড়ে তুললেন চরম দারিদ্রক্লিষ্ট পুরুলিয়া জেলার রুক্ষ শুষ্ক কাঁকুরে মাটির অঞ্চল গড় জয়পুরের পুন্দাগ রেল স্টেশনের নিকটবর্তী গ্রামগুলি নিয়ে৷ নাম হলো আনন্দনগর৷ নির্জন পাথুরে মাটির বুকে গড়ে উঠলো বিদ্যালয়, মহা বিদ্যালয়, শিশুসদন, হাসপাতাল, অন্ধ-মুক-বধির শিক্ষাকেন্দ্র....বহুমুখী সেবাকেন্দ্র৷ অবহেলিত বঞ্চিত মানুষগুলো পেল শিক্ষার আলো, বেঁচে থাকার রসদ৷

১৯৬৭ সাল, পশ্চিম বাংলায় রাজনৈতিক পর্ব পরিবর্তনে শাসন ক্ষমতায় আসুরিক শক্তি সিপিএম ও অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেস সহ কয়েকটি সরিক দলের যুক্তফ্রন্ট৷ স্বরাষ্ট্র দপ্তর উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর হাতে ছিল৷ আনন্দনগরের উন্নয়ন সহ্য হলো না আসুরিক শক্তির আধুনিক প্রজন্ম কম্যুনিষ্টদের৷ আনন্দনগর ধবংস করতে ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ সিপিএমের গুণ্ডা বাহিনী স্থানীয় ব্লক আধিকারিকদের সাহায্যে আনন্দনগর আক্রমন করে৷ সেই আক্রমন প্রতিহত করতে এগিয়ে যায় আনন্দমার্গের সর্বত্যাগী কর্মীবৃন্দ৷ কম্যুনিষ্ট নর পিশাচরা হত্যা করে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র পাঁচজন সন্ন্যাসীকে৷ দিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ৷ সেই পাঁচজন হলেন আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, অবোধ কুমার, ভরত কুমার, প্রভাস কুমার৷

না, আনন্দমার্গ, আনন্দনগর ধবংস হয়নি, আনন্দমার্গের বিজয় পতাকা স্বগৌরবে উড়ে চলেছে৷ বাঙলা ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের বহু দেশে৷ কিন্তু কম্যুনিষ্টদের অস্তিত্ব আজ চরম সংকটে৷

সেই দিন থেকে প্রতি বছর আনন্দমার্গীরা বিশ্বের সর্বত্র দধীচি দিবস পালন করে৷ কেন দধীচি দিবস পালন করে? বাংলায় শহীদ শব্দটি বহুল প্রচলিত৷ মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ইসলাম ধর্মের জন্যে সংগ্রাম করে জয়ী হলে তাঁদের বলা হয় গাজী আর যাঁরা সংগ্রামে নিহত হন তাঁদের বলা হয় শহীদ৷ তেমনি খ্রীষ্ট ধর্মের জন্যে সংগ্রামে নিহতদের বলা হয় ম্যাটার Martyr)৷ এই শব্দ দুটি বিশেষ রিলিজিয়নের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ দধীচি পুরাণের এক শিক্ষণীয় কাহিনী৷ মানব কল্যাণে অক্লেশে প্রাণ ত্যাগের প্রতীক দধীচি৷ সেদিন পুরুলিয়া জেলার আনন্দনগরে পাঁচ জন সন্ন্যাসী জীবন দিয়েছিলেন মানবজাতির কল্যাণে৷ কারণ আনন্দনগর সর্বশ্রেণীর মানুষের শিক্ষা ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত৷ তাই পুরাণের দৃষ্টান্ত নিয়ে ওই পাঁচজন সন্ন্যাসীকে দধীচির মর্যাদা দিলেন আনন্দমূর্ত্তিজী৷ তাই এই ৫ই মার্চ দধীচি দিবস পালন করা হয়৷