মানবীয় ঐক্যকে যারা বাধা দিচ্ছে বা বাধা দেবার চেষ্টা করে তাদের মধ্যে দলীয় রাজনীতি অন্যতম l বস্তুতঃ এই দলীয় রাজনীতি জিনিসটা রোগজীবাণুর চাইতেও ভয়ঙ্কর । এতে ধীরে ধীরে মানব মনের সমস্ত সুকুমারবৃত্তি, সমস্ত সরলতা তথা সেবাপরায়ণতা সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এতে ব্যষ্টির যোগ্যতার চাইতে দলীয় তকমার মর্যাদা শীতে, জনসেবা নয়---আত্মসেবাই প্রধান লক্ষ্য, কল্যাণ নয়---মন্ত্রিত্বই বড়, জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়া ডিগ্বাজী খাওয়া এগুলো খুই সাধারণ জিনিস নিজেকে সংশোধন করবার চেষ্টা না করে এরা কেবল বচনবাগীশতার দ্বারাই সকিছু করে ফেলতে চায় জনসাধারণের দুর্বলতাগুলো বুঝে বড় বড় বুলি কপচিয়ে জনসাধারণের একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে এরা রাষ্ট্রের গদী দখল করতে চায় বা কায়েম দ্দাখতে চায়৷ মানুষকে এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে৷ সমাজ জীবনে, ধর্ম-জীবনে, শিক্ষা-ক্ষেত্রে, সাহিত্য-ক্ষেত্রে সর্বত্রই এরা নাক গলাতে চায়৷ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা বা বিচক্ষণতানকবল যে বত্তৃণতামঞ্চে বড় বড় বুলি আউড়ে গিয়ে অর্জন করা যায় না---ক্ষমতার মোহে এ কথাটা তারা ভুলে থাকতে চায় ৷
সৎ তথা জনকল্যাণকামী ব্যষ্টিদের তাই দলীয় রাজনীতি থেকে সযত্নে দূরে থাকা উচিত৷ প্রশ্ণ উঠতে পারে এই যে দলীয় রাজনীতি না থাকলে সৎ ব্যষ্টিরাও এককভাবে রাষ্ট্র-গঠনে বা রাষ্ট্র-সেবায় সাফল্য লাভ করতে পারবে কি? তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন কি একেবোরেই নেই? এর জাবে আমি বলব যারা সৎ, যারা সত্যিকারের জনকল্যাণকামী, যারা বিশ্ব-রাষ্ট্রের তথা আনন্দ-পরিবারের আদর্শে বিশ্বাসী, তাদের মধ্যে সহযোগিতার ভাব থাকতেই হবে, নিছক মিলিতভাবে জনসেবা করবার উদ্দেশ্য নিয়ে (দল পাকবার উদ্দেশ্যে নয়) এঁরা বোর্ড গোছের কোনো কিছু গড়ে নিতে পারেন৷ কিন্তু বোর্ডের পক্ষ থেকে বোটাবুটি [voting] প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা উচিত হবে না ৷লোকে বোট দেবে যোগ্য মানুষকে---দলে টিকিট আটা ল্যাম্প পোষ্টকে নয়৷ দলীয় রাজনীতি প্রকাশ্যে যেগুলোর বিরোধিতা করে, গোপনে গোপনে দলীয়স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সেগুলোকে প্রশ্রয় দেয়৷ সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতিবাদ, দলীয় স্বার্থের খাতিরে এগুলো কেউই খারাপ নয়৷ মানুষের একমাত্র পরিচয় যে সে মানুষ বা জীব দলীয় রাজনীতি একথাটা ভুলিয়ে রাখতে চায়---দলীয় স্বার্থের ষ্টীম-রোলার চালিয়ে দিয়ে মানুষের মানস-সম্পদকে গুঁড়িয়ে ধূলো করে দিতে চায়৷
সৃষ্টি যতদিন আছে বিদ্যা ও অবিদ্যার সংগ্রাম চলবেই আধ্যাত্মিকতা-বিমুখ রাজনীতিকরা বত্তৃণতামঞ্চে বড় বড় বুলি কপচিয়ে বা সাদা পায়রা উড়িয়ে দিয়ে সে সংগ্রাম বন্ধ করতে পারবে না৷ অবিদ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে মানুষকে শক্তিশালী হতে হবে৷ এ ব্যাপারে অস্ত্র শক্তি, মানসিক শক্তি ও অধ্যাত্ম-শক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ কপটাচারণই যাদের পেশা অধ্যাত্ম সাধনা তারা করবে না৷ স্বার্থের তাগিদে আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে বড় বড় লেকচার দিলেও জনসাধারণকে আধ্যাত্মিক সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে এরা পারবে না---সেই চারিত্রিক দৃঢ়তা এদের নেই ভাঁওতা বাজীতে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে জনসাধারণ এই ধরণের নেতাদের কাছ থেকে মানসিক সম্পদেরও কোননো উপকরণ পাবে না৷ সুতরাং শেষ পর্যন্ত নির্ভর করতে হবে কেবল অস্ত্র-বলেরই ওপর৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কেবল পশুশক্তিই এই সকল রাজনীতিকের একমাত্র ভরসা৷
****
দলীয় রাজনীতির ধাপ্পৰাজীতে জনসাধারণকে সাময়িক ভাবে বিমূঢ় করে ফেলা যায়৷ বিশেষ করে এই ধাপ্পাবাজেরা যদি ভাল বক্তা হয়৷ বত্তৃণতার জেরেই তারা তাদের কৃত কর্মের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার চেষ্টা করে৷ দেখা যায় দলীয় স্বার্থ তথা প্রতিষ্ঠা জায় রাখবার জন্যে রাজনীতিকেরা কোটি কোটি মানুষের ক্লেশের কারণ হতেও কুণ্ঠা বােধ করে না৷ কর্তব্যের খাতিরে জনসাধারণের হয়তো উচিত অপরাধী নেতৃবৃন্দকেimpeach (আদালতে বিচার) করা৷ কিন্তু দলীয় স্বার্থের ধবজাধারীরা অল্পবুদ্ধি জনসাধারণের কাছে গরমা-গরম দু-চারটে কথা শুণিয়ে দিয়েই তাদের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা-সমৃদ্ধির সকিছুকেই ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়৷ বিভিন্ন ধরণের উদ্ভট উদ্ভট ভাব জনসাধারণের মনের মধ্যে তাল-গোল পাকাতে থাকে--- তারা তাদের বক্তব্য হারিয়ে ফেলে৷
আজকের সমস্যা বই থেকে