দুর্নীতি-অপরাধ ও জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে সেদিনের বিরোধী নেত্রী স্লোগান দিয়েছিলেন ‘‘বদলা নয় বদল চাই’’৷ পশ্চিমবঙ্গবাসী সেই বদলের আশাতেই ৩৪ বছরের হার্র্মদ রাজের অবসান ঘটিয়ে বিরোধী নেত্রীর হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দেয়৷ গত ১২ বছরে বদল যে হয়নি তাতো নয়! যার সুফল গরীব মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পৌঁছেও যাচ্ছে৷ তবু বহু আশার দুর্নীতির রাহুমুক্ত পশ্চিমবঙ্গ হতে পারলো কই! নিয়োগ দুর্নীতি, গোরুপাচার এসব পশ্চিমবঙ্গে নূতন কিছু নয়, বাম আমলেও অবাধে হয়েছে৷ তবে সমাজ মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তে এখন যেমন প্রচারের ঢক্কানিদানে অনেক সময় তিলকেও তাল করে প্রচার হচ্ছে তখন সে সুযোগ ছিল না৷ তাছাড়া বামফ্রন্টের প্রথম পাঁচটা বছর বাদ দিলে বাকী সময়টা কেন্দ্র রাজ্য পরস্পরের উপর নির্ভর করে নতুবা গোপন বোঝাপড়া করে চলেছে৷ তাই দিল্লীর শাসকদল পশ্চিমবঙ্গের দলীয় কর্মীদের উপর অত্যাচারেও নীরব থেকেছে৷ শুধুমাত্র এই কারণেই কংগ্রেস ভেঙে মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও রাজ্যে বাম আমলের অবসান৷

মুখ্যমন্ত্রীর বদলের ডাকে অনেক ভালো পরিবর্তনের মধ্যে একফোঁটা চোনা ঢেলেছে বাম আমলের বহু হার্র্মদের ঝাণ্ডা বদল৷ দুর্নীতিতে এখনও পশ্চিমবঙ্গ বহু পিছনে আছে অনেক ডবল ইঞ্জিন শাসিত রাজ্যের থেকে৷ দুর্নীতির এই পরিমাপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাসীর গর্বিত হওয়ার কিছুই নেই৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসীর আশ্বাস ও গর্বের জায়গায় আঘাত হেনেছে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কিছু রোমহর্ষক অমানবিক ঘটনা৷

কলকাতার উপকন্ঠে সোনারপুর শহরে এক নজরকাড়া প্রাসাদ, কিন্তু সেই প্রাসাদের অভ্যন্তরের কিছু ব্যবস্থা যা সাধারণ মানুষের নজরে পড়ে না, পড়ার কথাও নয়৷ কিন্তু সেই দৃশ্য প্রকাশ্যে আসতেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দেয়৷ অন্যরাজ্যের দিকে আঙুল তোলার আগে এবার শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের একটু নিজের দিকে তাকাবার সময় দিতে হবে৷

যে প্রাসাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রাসাদের মালিক শাসকদলের ঘনিষ্ট জনৈক জমি ব্যবসায়ী জামাল সর্দার৷ তার প্রাসাদোপম বাড়ির পাথর বসানো মেঝেতে শিকল বাঁধার আংটা লাগান৷ ঘরেতে বাঁশ ও অন্যান্য উপকরণও মজুত থাকে, এক কথায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার আয়োজন বলা চলে৷ কেন এই আয়োজন? এই ঘরেই বসে জামাল সর্দারের বর্বর বিচারসভা৷ এই বর্বর সভাতেই স্থানীয় এক মহিলার বিচারের নৃশংস দৃশ্য প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্যজুড়ে সরগোল বেধেছে৷ ঘরের আংটায় শিকলে বেঁধে বাঁশ দিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করা হচ্ছে ওই মহিলাকে৷ ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে শোণা যাচ্ছে এই নৃশংস বিচার এই প্রথম নয়৷ আরও অনেক মহিলা এই নৃশংসতার শিকার হয়েছে৷

এই ধরণের জামাল সর্দারদের নৃশংস বিচারের বহুসংবাদ যখন রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক, হরিয়ানা থেকে ছাড়িয়ে পড়তো তাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেদনায় বিচলিত হলেও গর্বে মাথা উঁচু করে বলতে পারতো -পশ্চিমবঙ্গে কখনও এই ঘটনা ঘটবে না৷ কিন্তু সেই গর্বের জায়গাটাও কেড়ে নিল জামাল সর্দাররা৷

পুলিশ প্রশাসনের এক অংশের সঙ্গে আতাঁত ছাড়া এই বর্বরোচিত বিচারসভার আয়োজন সম্ভব নয়৷ শুধু এই একটি বিচারসভা নয়-জামাল-সাজাহান-জয়ন্ত দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বাড়ছে তার দায় কি.পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধায়ক, সাংসদ সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিদের নয়! দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগ না থাকলেও তাদের উদাসীনতাও দায়ী এই জঘন্য নির্মম ঘটনার জন্যে৷ একজন জনপ্রতিনিধির কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে তার নির্বাচিত এলাকায় জনগণ কেমন আছে কোথাও কেউ অত্যাচারিত নির্যাতিত হচ্ছে কি না, কাদের মদতে কারা বর্বরোচিত ঘটনা ঘটাতে সাহস পাচ্ছে তাঁর খোঁজ নেওয়া৷ কিন্তু বহুক্ষেত্রেই বিপরীতটাই ঘটে থাকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তোলাবাজি থেকে শুরু করে বহু দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় কোন কোন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে৷

শাসকদলের প্রধান সেনাপতি নির্বাচনে ভোট কম পাওয়ার দায় স্থানীয় স্তরের জনপ্রতিনিধিদের ঘাড়ে চাপিয়ে সাবধান বানী শুনিয়েছেন৷ ভোট বাড়াতে পারলেই যদি সাত খুন মাপ হয়ে যায় তবে ছলে বলে কৌশলে ভোট বাড়ানোর অপচেষ্টা চলবেই৷ তাই একজন জনপ্রতিনিধির দায়ীত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে সতর্ক করা প্রয়োজন--- নির্যাচিত জনপ্রতিনিধির এলাকায় যে কোন দুর্নীতি ও নৃশংস ঘটনার দায় নিতে হবে ওই জনপ্রতিনিধিকেই৷ একজন নির্বাচিত জন প্রতিনিধির এলাকার কোথায় কি দুষ্কর্ম ঘটছে তার খোঁজ তো জনপ্রতিনিধিকেই রাখতে হবে৷ যদি জন প্রতিনিধিরা নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন তবেই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ২১-এর জনসভায় দাঁড়িয়ে যে বিবেকের কথা বলেছেন হয়তো জাগবে সেই বিবেক৷