আনন্দনগরে মহাসমারোহে আনন্দমার্গের ধর্মমহাসম্মেলন হয়ে গেল৷ এই ধর্ম মহাসম্মেলনের মাধ্যমে যে মূল কথাটা মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, তা হ’ল প্রকৃত ধর্মই মানবজীবন তথা মানব সমাজের ভিত্তিভূমি৷ আর এই ধর্ম তথাকথিত সাম্প্রদায়িকভিত্তিক ধর্মমত বা রিলিজিয়ন নয়, এখানে কোনো ডগ্মা তথা অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের স্থান নেই৷ যেমন, বর্তমানে ধর্মের নামে সারা দেশ জুড়ে চলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস৷ হিন্দুত্ববাদীরা ‘গো-রক্ষা’র আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করছে৷
হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সৃষ্টি করে’ সামাজিক পরিবেশকে দূষিত ও অশান্ত করে তুলছে৷ কেরালার শবরীমালা মন্দিরে চরম অযৌক্তিক কুসংস্কারপূর্ণ প্রথাকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটছে৷ সারা রাজ্য জুড়ে সংঘর্ষ ও সরকারী সম্পত্তি নষ্ট চলছে৷ আসলে এগুলোর সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের কোনোমাত্র সম্পর্ক নেই৷ ধর্ম অযৌক্তিক, অমানবিক ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করে না৷ যদি করে থাকে তাহলে স্পষ্টতই তা ধর্ম নয়, ধর্মের নামাবলি গায়ে দেওয়া ডগ্মা বা ভাবজড়তার কথা অন্ধবিশ্বাস মাত্র৷
ধর্ম হল অধ্যাত্মবিজ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা তা কোনো ভিত্তিহীন কল্পনা বিলাস (Utopian idea) নয়৷
মহান ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, আধ্যাত্মিক তাকে আমরা আমাদের কঠোর বাস্তব দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন ও উপলদ্ধি করতে পারি৷ এই আধ্যাত্মিকতা হল মানবমনের বিবর্তন তথা সর্র্বেচ্চ স্তরে উত্তরণের elevation) নামান্তর, এর সঙ্গে কুসংস্কার ও নৈরাশ্যবাদের সম্পর্ক নেই, যে সমস্ত বিচ্ছিন্নবাদী প্রবণতা বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ভাবনা-চিন্তা মানুষের মনকে সংকীর্ণতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই৷ এইসব ভাবজড়তাকে (ডগ্মা) মোটেই উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়৷ যা মনকে প্রসারিত করে ও ঐক্যের ভাবনা জাগায়---তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য৷ আধ্যাত্মিকতা মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভেদকে স্বীকার করে না৷ আধ্যাত্মিকতা বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলে৷
চতুর্দিকে ধর্মের নামে নানান্ গোঁড়ামী, ডগ্মায় লড়াই, অন্ধবিশ্বাস -কুসংস্কারের বীভৎসতা--- এসব দেখে অনেকেই ধর্ম সম্পর্কে -বিভ্রান্ত৷ আর এই বিভ্রান্তের সংখ্যা সমাজে -অত্যন্ত বেশি৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই, তথাকথিত শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবিরাও বেশির ভাগই বিভ্রান্ত৷
এঁদের আবার বেশীর ভাগ নিজেদের অজান্তেই নানান্ ডগ্মার দ্বারা প্রভাবিত৷ ডগ্মায় আচ্ছন্ন হয়ে প্রকৃত ধর্মকে চেনবার বা বোঝবার চিন্তাশক্তিই তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন৷
তাহলেও বলব, অন্ধকার খুববেশী দিন থাকে না৷ সত্যভ্রষ্টা মহামনীষীরাও কম্যুকন্টে ঘোষণা করে গেছেন প্রকৃত ধর্মের অভ্যুত্থান আসন্ন৷ আবার বলি, এ ধর্ম মানে সর্বজনীন মানব ধর্ম ---যাকে আমরা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বলতে পারি৷
জড়বাদী জীবনধারা আজ পৃথিবীকে স্বার্থ লোলুপ নীতিহীন, শৃঙ্খলাহীন, মানবতাহীন জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করেছে৷ নীতিহীন মানব সমাজ ধবংসের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে৷ এ অবস্থায় এই উন্মার্গগামী বিভ্রান্ত মানব সমাজ কে রক্ষা করতে নীতিবাদী শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াবে ও এই জড়বাদ ভোগবাদের পিশাচ নৃত্য স্তব্ধ করে দিয়ে সুদৃঢ় আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক নীতিবাদী সমাজের পত্তন করবে৷ ইতিহাসের এটাই নিয়ম৷ গীতার বানী থেকে শুরু করে সমস্ত সত্যদ্রষ্টা মহান মনীষীদের বানীই এটাই সারমর্ম৷
স্বামী বিবেকানন্দ একজন পরাধীন দেশের মানুষ হয়েও মদগর্বী পাশ্চাত্ত্যের বুকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ এক জীবন্ত আগ্ণেয়গিরির ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ যে কোনো মুহূর্তে এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে৷ বাঁচতে হলে জড়বাদী পাশ্চাত্যকে নতজানু হয়ে ভারতের আধ্যাত্মিকতার কাছে দীক্ষা নিতে হবে৷ অন্যত্র তাঁকে আরও বলতে শুণি , অদূর ভবিষ্যতে এক ব্রহ্মবাদ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না৷ এই কারণে তিনি নিজে অদ্বৈত আশ্রমও গড়ে তুলেছিলেন৷
সত্যদ্রষ্টক কবি রবীন্দ্রনাথও তার ‘বর্তমান যুগ’ প্রবন্ধে বলেছেন, আজ সারা বিশ্বজুড়ে সমাজের সর্বস্তরে এক বিরাট পরিবর্তন আসন্ন৷ বাইরে থেকে তাকে রাজনীতি বলে ভ্রম হলেও আসলে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আজ একটা ধর্মের বিদ্যুৎ শক্তি ছুটে চলেছে৷ এই ধর্মই সারা পৃথিবীকে রক্ষা করবে৷
বলা বাহুল্য স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি যে ধর্মের কথা বলেছেন, সে ধর্ম-বিশ্বজনীন মানবধর্ম কোনো সম্প্রদায়ভিত্তিক সংকীর্ণ ডগ্মার সমষ্টির নয়৷
আনন্দমার্গ বিশ্বজুড়ে সেই সার্বভৌম মানবধর্মেরই প্রচার করছে৷ এই ধর্মসাধনার দৈনন্দিন অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে৷ মানব হয়ে উঠবে বিশ্বমানব৷ এটাই শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর ‘নব্যমানবতাবাদের’ সারকথা৷ যেখানে ‘প্রভাত সঙ্গীতের ভাষায় তিনি বলেছেন’ ‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়/ এ কথাও যেন মনে রাখে পশুপাখি তার পর নয়৷ তরুও বাঁচিতে চায়৷’’
এই নব্যমানবতাবাদীদের্ কাছে কোনও মানুষও তারপর নয়৷ প্রকৃত অধ্যাত্মবাদীদের মতে ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই’৷ তাদের্ বলা হবে ‘সদবিপ্র’, তারাই সমস্ত পৃথিবীকে সমস্ত অন্যায়, শোষণ, পাপাচার ও সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অভাব ও অজ্ঞতা থেকে দৃঢ়হস্তে রক্ষা করবে৷ তখন আর কোনও প্রকার ডগ্মা কোনও প্রকার অন্যায় বা শোষণ আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারবে না৷
- Log in to post comments