এই কি রাজধর্ম

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

দিল্লী আগুনে জ্বলছে৷ সিএএ পন্থী ও সিএএ বিরোধীদের মধ্যে লড়াই চলছে৷ যেন পুরোপুরী যুদ্ধক্ষেত্র৷ এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত পুলিশের রিপোর্টেই বলা হচ্ছে, ৫০০ রাউণ্ড গুলি চলেছে৷ মূলত লড়াই চলেছে ওই দুই পক্ষের মধ্যেই৷ এ পর্যন্ত মৃত ৫০ জন, আহত ২৫০-এর বেশী৷ পুলিশের গুলিতে কেউ মারা যায়নি বলে পুলিশেরই রিপোর্ট৷ গুলির সঙ্গে চলেছে অ্যাসিড ছোড়া, পুড়ছে ঘরবাড়ী, গাড়ী, সুকটার৷ এখন প্রায় সমস্ত উত্তরপূর্ব দিল্লী জ্বলছে৷ এ আগুনই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা৷ বিস্ময়ের বিষয় এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘটনাস্থলে গিয়ে শান্তির জন্য আবেদন করা, দুই পক্ষকে শান্ত করা---এসব করতে দেখা যায়নি৷

কিন্তু কেন? কেন এই হিংসাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে? এই আগুন জ্বলার পেছনে যে কেন্দ্রীয় সরকারেরই সিএএ, এনআরসি পলিসি---এ তো সবাই জানেন৷

সরকার বলছেন স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে সমস্ত হিন্দুরা তথা অমুসলীমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এ দেশে এসেছেন সিএএ আইনে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে৷ কেন্দ্রীয় নেতারা যুক্তি দেখিয়ে চলেছেন, এটা তো মানবিক কর্তব্য৷ এই আইনে তো নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে৷ কারুর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না৷

যেমন বাঙলার কথাই ধরা যাক৷ বিজেপি নেতারা কলকাতার শহীদ মিনার ময়দানে বলেছেন ওপার থেকে যে বাঙালীরা শরণার্থী হয়ে এ দেশে এসেছেন এই আইনে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ যেহেতু প্রতিবেশী দেশগুলি মুসলিম দেশ (পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাঙলাদেশ) ওই সব দেশ থেকে তো মুসলিমদের শরণার্থী হয়ে আসার প্রশ্ণ নেই, তাই তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ারও প্রশ্ণ ওঠে না৷ এই বলে বিজেপি নেতারা হিন্দুদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন৷

ঠিক আছে, প্রথমে হিন্দুদের প্রশ্ণেই আসা যাক৷ স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরে যখন পাকিস্তান থেকে প্রচণ্ড উদ্বাস্তুর স্রোত আসছে প্রথম প্রথম যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হ’ল৷  কিন্তু বাঙালীদের জন্য কিছুই করা হয়নি৷ পরবর্তীকালে নেহেরু, পটেল সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করলেন পশ্চিম পাকিস্তান বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভবিষ্যতে যে কোন সময় যারা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে চলে আসবেন তাদের জন্যে ভারতের দ্বার সসম্মানে খোলা রইল৷

এর পর বহু উদ্বাস্তু এসেছেন৷ বিশেষ করে তাদের অধিকাংশ সরকারী সাহায্যে না পেলেও অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকার করে কোন রকমে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করেছেন৷ অনেকে স্বীয় চেষ্টায় চাকরী-বাকরী জুটিয়েছেন, ব্যবসাপত্র করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন৷ বলা বাহুল্য স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদেরও সমান অবদান৷ ওপার বাঙলার বাঙালীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অকাতরে রক্ত দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, দীপান্তরিত হয়েছেন তাই স্বাধীন ভারতে নাগরিকত্ব তাদের জন্মগত অধিকার৷ ভাগ্যের পরিহাসে তারা ঘরবাড়ী ছেড়ে কোনরকমে এদেশে এসে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করছেন৷ স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন সময় সরকারী উদ্যোগে তারা বোটার কার্ড করেছেন, আধার কার্ড করেছেন৷ এদেশে তারা বৈধ নাগরিকত্ব লাভ করেছেন৷

হঠাৎ বিজেপি সরকার বলছেন, তারাই নাকি এতদিন পর তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন৷ এটাই তো মিথ্যা প্রচার৷ পূর্ব পাকিস্তান বা বাঙলাদেশ থেকে আসা বাঙালীরা যারা এদেশে বোটার কার্ড নিয়ে নিয়মিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের নাগরিকত্ব তো সরকারী ভাবেই স্বীকৃত৷ তারপর আধার কার্ড হয়েছে৷ এখন হঠাৎ বিজেপি সরকার বলছে, না, এটা নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়৷ এদের বোটে জিতেই বিজেপি নেতারা এম.এল.এ., এম.পি.  মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন৷ এরা যদি বৈধ নাগরিক না হয় তাহলে এই নেতা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও তো অবৈধ! তাদের আইনী পাশ করাও তো অবৈধ৷

তাদের যদি এতদিন এদেশে বৈধ নাগরিক বলে বিজেপি সরকার স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে তো আবার আইনগত প্রশ্ণ তুলতে পারেন, এতদিন যে এরা সরকারী সুযোগ সুবিধা নিয়েছে, সরকারী চাকরী নিয়েছে, রেশন কার্ড, বোটার কার্ড করেছে, আধার কার্ড করেছে---সবই বে-আইনীভাবে করেছে, মানে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছে৷ অর্থাৎ আইনত দণ্ডনীয়৷ সমস্যা তো আরও জটিলতর হয়ে যাচ্ছে৷ তাই বিজেপি সরকার সি.এ.এ এনে তাদের কতটুকু উপকার করছেন?

আসলে ব্যাপারটা হ’ল এ যেন একটা বড় জাহাজে করে সবাই সমুদ্র যাত্রা করছে৷ যাত্রীদের মধ্যে অনেককে জোর করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হ’ল৷ তারপর পছন্দমত কাউকে কাউকে বাঁচাবার জন্যে তাদের সামনে মোটা দড়ি ছঁুড়ে দিয়ে তাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেওয়া হ’ল৷ আর যাদের পছন্দ নয় তারা ডুবে মরুক৷ সরকার বলছেন প্রতিবেশী দেশগুলি যেহেতু মুসলিম দেশ তাই তাদের ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসার প্রশ্ণই ওঠে না৷ তাই তাদের ক্ষেত্রে শরণার্থী হওয়ার প্রশ্ণই নেই৷ সরকার যখন স্বীকার করছেন প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে মুসলিম শরণার্থী হওয়ার প্রশ্ণ ওঠে না, তাহলে সিএএ আইনে খামাখা অমুসলিম শব্দ ব্যবহারের যথার্থতা কী? তাহলে এই বিভাজন কী প্রয়েজন ছিল? সংবিধানে হিন্দু মুসলিম বিভাজনকে এইভাবে স্বীকৃতি দেওয়া তো ভাল হয়নি৷ কোনও এক বিশাল অট্টালিকায় একটা সামান্য ফাটল যে পরবর্তীকালে বিশাল ফাটল হয়ে দেখা দেয়, আর তা অট্টালিকার পক্ষে দারুণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তা কি তারা বোঝেন না?

এছাড়া সিএএ, এনআরসি একসূত্রে গাঁথা৷ সামনে অসম মডেলও রয়েছে৷ অসমের বহু পুরোনো বাসিন্দা---তারা যে এখানকার বহু পুরোনো বাসিন্দা তার বহু নথি দেখানো হচ্ছে, কিন্তু আধিকারিকরা মান্যতা না দেওয়ায় তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ এমন অনেকে হতাশায় আত্মহত্যাও করেছেন৷ এছাড়া বহু গরীব মানুষ যারা বন্যায়, ভূমিকম্পে বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন, তাদের পক্ষে বহু পুরোনো নথি রাখা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে তারা তো রাষ্ট্রহীন হয়ে যাবে৷ ফলে তারা চরমভাবে আতঙ্কগ্রস্ত ৷ তারা এই ভূমিতে জন্মেছেন, এই ভূমিকে নিজের ভেবে এই এলাকার স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছেন, এরা এখন কোথায় যাবেন, কী করবেন? তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করবার অধিকার কোন সরকারের আছে কি? নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চরম আতঙ্কে তারা এখন দিশাহারা৷ তাই তারা আজ মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নেমেছে৷ এখন সরকারের উচিত তাদের আশ্বাস দিয়ে শান্ত করা৷ তাদের ওপর এইভাবে আক্রমণকে কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নেবে না৷ তাই সরকার, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করে যথার্থ রাজধর্ম পালন করুন৷ ইতোপূর্বে বিজেপির প্রয়াত নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী যে রাজধর্ম পালনের কথা মোদীজীকে বলেছিলেন বর্তমান বিজেপি কর্মকর্তাদের সেই নির্দেশ পালন করা অত্যন্ত জরুরী৷