একের আধিপত্য মানুষ মেনে নেবে না

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘বৈচিত্র্যং প্রাকৃত ধর্মঃ সমানং ন ভবিষ্যতি৷’’ বৈচিত্রই প্রকৃতির ধর্ম৷ সৃষ্ট জগতের কোনও দুটি বস্তু হুবহু এক নয়৷ দু’টি মন এক নয়, দুটি অণু বা পরমাণুও এক নয়৷ এই বৈচিত্র্যই প্রকৃতির স্বভাব৷ যদি কেউ সবকিছুকে সমান করতে চায় সেক্ষেত্রে প্রাকৃত ধর্মের বিরোধিতা করায় অবশ্যই ব্যর্থ হবে৷ সব কিছু সমান কেবল প্রকৃতির অব্যক্ত অবস্থায়৷ তাই যারা সব কিছুকে সমান করার কথা ভাবে, তারা সব কিছুকেই ধবংস করার কথা ভাবে৷ .....সবাইকে যেমন এক ছাঁচে ঢালা যাবে না, তেমনি বৈচিত্র্যের ধূয়ো তুলে কেউ যাতে শোষণ করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে৷ বৈচিত্র্য স্বীকৃতি দেয় বহুত্বকে, আর তারই মাঝে বিচ্ছুরিত হয় ঐক্যের দ্যুতি৷

তাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, এটাই বিশ্বপ্রকৃতির মূল সুর৷ ভারতীয় সংবিধানের কথা বলতে গেলেও এটাই আমাদের সংবিধানের মূল কথা৷ গণতন্ত্রেরও মূল কথা এটাই৷ বিশ্বমানবতার আধার শিলাও এটাই---বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা৷

কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নানা অছিলায় এক ভাষা, এক আইন, একরাষ্ট্র স্লোগান তুলে দেশের সংবিধানের তথা গণতন্ত্রের গোড়াতেই কুঠারাঘাত করেছেন৷ ইতোপূর্বে হিন্দী, হিন্দু, হিন্দুস্থান শ্লোগান তুলে দেশজুড়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে৷ এদেশে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান এই বিবিধের মধ্যে ঐক্যই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণভোমরা৷ কেন্দ্রীয় সরকার কী এই প্রাণভোমরাকে দু’হাত দিয়ে টিপে মারতে চান? তার পরিণাম যে মোটেই ভাল হবে না, তা কি ইতোপূর্বে সরকার উপলব্ধি করতে পারেননি? এর আগে হিন্দীকে অন্যান্য রাজ্যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজ্য মুখর হলেও কি কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম ভাঙ্গে নি?

ইতিমধ্যে এক রাষ্ট্র এক ভাষা---দেশের সব প্রান্তে হিন্দীকে চালু করার এই প্রস্তাব পত্রপাঠ অস্বীকার করেছে পূর্ব ও দক্ষিণের সব কয়টি রাজ্যই৷

‘ভারত যখন সাধারণতন্ত্র দেশ হিসেবে ঘোষিত হয় তখন আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলুম বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই আমাদের মন্ত্র৷ এখন কোন শাহ, সুলতান বা সম্রাটের সেটা লঙ্ঘন করার স্পর্ধা দেখানো উচিত নয়৷ ভাষার জন্যে আবার যদি আমাদের লড়াই করতে হয় তার মাত্রা ও ব্যাপ্তি হবে বহুগুণ৷ এই যুদ্ধ ভারতের জন্যে কাম্য নয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারের এই অপপ্রয়াস ভারতকে সোভিয়েত পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে৷

প্রকৃত চিত্র কিন্তু অন্য৷ উত্তর ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে অঙ্গিকা, মৈথিলী, নাগপুরিয়া, অবধি, ভোজপুরী প্রভৃতি ঐতিহ্যপূর্ণ ভাষাগুলিকে জোর করে দাবিয়ে দিয়ে তাদের ওপরে হিন্দী চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷

আসলে হিন্দী নিতান্ত অর্বাচিন ভাষা৷ হিন্দীর তুলনায় অঙ্গিকা, মৈথিলী, নাগপুরিয়া, অবধি, ভোজপুরী---এসব ভাষা অনেক প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ৷ মুঘল আমলে রাজধানি দিল্লীর আশপাশে নবাবের উর্দীধারী সেনাবাহিনীর লোকেরা স্থানীয় ভাষা ও আরবি ভাষা মিলিয়ে এক মিশ্র ভাষাতে কথাবার্তা বলত৷ লোকে এই ভাষাকে বলত উর্দু ভাষা৷ উর্দি (সেনাবাহিনীর পোষাক) পরা লোকজন ওই ভাষাতে কথা বলত বলেই এই নাম হয়েছিল৷ দিল্লীর চারপাশের স্থানীয় এলাকাতে লোকে এই ভাষাতেই কথা বলতে থাকে৷ পরবর্তীকালে মুঘল আমল শেষ হওয়ার পর এখানে মুসলিম প্রভাব কমলে তখন স্থানীয় হিন্দু পণ্ডিতরা প্রচলিত এই উর্দু ভাষা থেকে আরবী শব্দ কমিয়ে সেই স্থলে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করে ভাষাটিকে ঈষৎ পরিবর্তন করে নাম দেয় হিন্দী৷ তারপর তারা এই ভাষাতেই লেখালেখি শুরু করলেন৷ তাই হিন্দী ভাষার বয়স আড়াইশো বছরের বেশী নয়৷ অথচ যে ভাষাভাষীদের ওপর জোর করে হিন্দী চাপিয়ে তাদের ভাষাকে হিন্দীর বুলি বা উপভাষা বলে দেখানো হচ্ছে, আসলে ওই অবধি, ভোজপুরী, অঙ্গিকা, মৈথিলী, নাগপুরিয়া, ছত্রিশগড়ী প্রভৃতি ভাষার বয়স হিন্দীর চেয়ে অনেক বেশী৷ এদের ভাষায় পুরোনো লোকসাহিত্যও আছে যা হিন্দীর নেই৷ এইভাবে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যান্য বহু ভাষাকে দাবিয়ে গলা টিপে হত্যা করে ওই ভাষাভাষীদের ওপর হিন্দী চাপিয়ে দিয়েছে৷

এখন ঠিক একইভাবে বাংলা সহ আরও অন্যান্য ভাষাতে জোর করে হিন্দীর অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে সবার ওপর হিন্দীকে চাপানোর প্রক্রিয়া সফল হয়নি৷ তাই সুকৌশলে এক দেশ এক আইন তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে৷  আসলে সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে চলার মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংহতি বিদ্যমান৷ জোর করে এক ক্ষুরে মাথা মুড়াবার প্রচেষ্টা থেকেই বিরোধের সূত্রপাত৷ কেন্দ্রের বর্তমান আচরণ ও তাদের নেতাদের কথাবার্তা দেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদের পথে নিয়ে যাচ্ছে৷ দেশের শান্তি ও সংহতির ওপর কুঠারাঘাত করা হচ্ছে৷  এ থেকে বিরত হোন৷ হঠকারী কাজ করবেন না৷ এ যুগে ডিক্টেটরশিপকে কেউ মেনে নেবে না৷ চারিদিকে বিদ্রোহ দেখা দেবে৷