গঞ্জের গজার গপ্পো

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ঠাঠ’ মানে আধার৷ এই আধার অর্থে ‘ঠাঠ’ শব্দের সঙ্গে তোমরা কেউ কেউ হয়তো পরিচিত আছ৷ পুরোহিতেরা তাঁদের নারায়ণের  সিংহাসনের যে আধারটিতে শালগ্রাম শিলা বসিয়ে রাখেন সেটিকেও ঠাঠ বলা হয়৷ তোমরা সেই ঠাঠের শালগ্রাম শিলার গল্প জানো তো? তবে শোনো, তাড়াতাড়ি শোনাচ্ছি৷

এক পুরোহিত তাঁর নারায়ণের সিংহাসন সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন দু’ক্রোশ দূরে এক শাঁসালো রসালো যজমানের বাড়িতে৷ অর্ধপথে এসেই পুরোহিত মশায় দেখলেন তিনি সিংহাসনের ঠাঠে শালগ্রাম শিলা রাখতে ভুলে গেছেন৷ কী করা যায়............কী করা যায় পুরোহিতেরা মানুষ চরিয়ে খান৷ সঙ্গে সঙ্গে মগজে বুদ্ধি খেলে গেল৷ রাস্তার পাশে পড়ে–থাকা একটা শুকনো শামুককে নিয়ে তিনি ঠাঠে বসিয়ে দিলেন৷ ভাবলেন–যজমান অতশত বুঝবে না৷ তারপর পুরোহিত মশায় যজমান বাড়িতে এসে যথারীতি পুজোয় বসলেন–অঙ্গন্যাস, করন্যাস, আচমনাদি যথাবিধি সারলেন৷ এবার মন্ত্রপাঠ করে পঞ্চপাত্র থেকে ছোট্ট হাতায় খানিকটা জল নিয়ে শালগ্রাম শিলার  ওপর ঢেলে শালগ্রাম শিলাকে* স্নান করাতে লাগলেন৷

এদিকে ব্যাপারখানা যা হবার তাই হল৷ জল পেয়ে শুকনো শামুকের খোল জেগে উঠল৷ সে তখন ঠাঠ ছেড়ে চলতে শুরু করলে– ঠাঠ ছেড়ে সিংহাসনে, সিংহাসন ছেড়ে মেঝেতে  তার চলার ধারা নির্ক্ষাধ গতিতে হতে থাকল৷ পুরোহিতের তো তখন চক্ষু ছানাৰড়া৷ যজমান বললে–এ কী হল ঠাকুর মশায়, এ কী হল ঠাকুর মশায়

একটু আগেই বলেছি, পুরোহিত মানুষ চরিয়ে খান৷ তাঁর উর্বর  মস্তিষ্কে আবার বুদ্ধি খেলে গেল৷ তিনি যজমানের দিকে চেয়ে বললেন, তোর কী সৌভাগ্য রে বেটাচ্ছেলে, তোর বাড়িতে এসে ঠাঠ ছেড়ে নারায়ণ চলতে শুরু করে দিয়েছে৷ এ যে সমগ্র মানুষ জাতির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা৷ অচল নারায়ণকে সচল হতে দেখে আজ শুধু তোর আর আমার নয়, বিশ্বের সমস্ত মানুষের আজ পৃথিবীতে আসা সার্থক হল৷ তবে এই ইতিহাস–সার্থক ঘটনাটিকে আরও ৰেশী মর্যাদা দিয়ে এক কাজ কর, তুই যা কিছু পুজোর উপকরণ–নৈবেদ্য, ধুতি–শাড়ী, দান–দক্ষিণা দিবি বলে ঠিক করেছিলি তার দশ গুণ বাড়িয়ে দে যাতে ঘটনাটা চিরদিন মনে থাকে–তোরও মনে থাকে, আমারও মনে থাকে৷

যজমান দেখলে–একটা শামুক জল পেয়ে চলছে৷ ত বুও ভয়ে ভক্তিতে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হল৷ সে কেবল একবার ভয়ে–ভক্তিতে পুরোহিতকে বললে– ঠাকুর মশায়, কালীর জন্যে একটা শাড়ি দিয়েছিলুম৷ এখন কি দশটা শাড়ি দিতে হবে

পুরোহিত মশায় বললেন–এক কথা কতবার বলব

যজমান বললে–ঠাকুর মশায়, কালী তো দিগম্বরা৷ শাড়ি তো তিনি পরেন না৷

পুরোহিত মশায় বললেন–এত বিদ্যে কে তোকে দিয়েছে বল তো শ্মশানে তিনি শাড়ি পরেন না, কিন্তু শহরে বাজারে যখন আসবেন তখন নিশ্চয়ই সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী ভাল শাড়ি পরেই আসবেন৷ হয় মুর্শিদাবাদী ছাপা সিল্কের শাড়ি কিংবা বেনারসী শাড়ি৷ তা এখনই যদি চুঁচড়ো–চন্নগরের বাজারে অতগুলো মুর্শিদাবাদী, বেনারসী শাড়ি জোগাড় করতে না পারিস তাহলে দুৃ’চারটে ভাল পাড়ের ভাল খোলের ধনেখালি–শান্তিপুরী শাড়ি হলেও কাজ চলবে৷ মায়ের তাতে কোনো আপত্তি হবে না, আমার তো হবেই না৷

যজমান বললে–কিন্তু ঠাকুর মশায় শিব ঠাকুর তো দিগম্বর, কিংবা তিনি বাঘছাল পরে থাকেন৷ তাঁকে দশটা ধুতি দিয়ে কী হবে–কী কাজে লাগবে?

পুরোহিত মশায়–তুই কিছুটা জ্ঞানের কথা বললি বটে, তবে শেষ রক্ষে করতে পারলি না৷ শিবের সম্বন্ধেও ওই একই কথা৷ তিনি শ্মশানে বাঘছাল পরে থাকেন বা দিগম্বর হয়ে ঘুরে ৰেড়ান কিন্তু দিন দুপুরে আমাদের চুঁচড়ো–চন্নগরে তো আর দিগম্বর হয়ে বা বাঘছাল পরে আসবেন না৷ আসবেন হয় ফিনফিনে ধুতি আর গিলে–করা পাঞ্জাবী পরে কিংবা ফুলপ্যান্ট আর বুশ শার্ট পরে৷  তবে দেখ ফুল প্যাে ন্টর অনেক ঝামেলা৷ আগে থেকে মাপ নিতে হয়৷ ভাল দর্জি দিয়ে কাটিং–সেলাই করাতে হয়৷ অত ঝামেলায় কেন যাবি  তার চেয়ে ভাল খোলের ভাল পাড়ের কয়েকটা শান্তিপুরী–ফরাসডাঙ্গ্ ধুতি দিলেই চলবে৷ আমাদের চুঁচড়ো–চন্নগরের বাজারে যে–কোনো সময় পয়সা ফেললেই ডজন ডজন ফরাসডাঙ্গা–শান্তিপুর্ ধুতি পাওয়া যাবে৷ আলু বেচার টাটকা টাকা তো তোর হাতেই রয়েছে৷ শিব ঠাকুর আশুতোষ আপনভোলা মানুষ৷ যা দিবি তাতেই সন্তুষ্ট হবেন৷ তুই যদি চটের মত মোটা ধুতিও দিস শিব ঠাকুরের তাতে কোনো আপত্তি হবে না কিন্তু আমার তো আক্কেল আছে৷ আমি কোন্ প্রাণে বলব–ঠাকুর, এই ধুতিটা কোমরে জড়াও৷ আমি প্রাণ থাকতে তা পারব না৷ আমি তো আর জ্ঞান–গম্যি খুইয়ে বসিনি৷

মা সেদিন স্বপ্ণাদেশে বললেন–দেখ, পৌরোহিত্য করতে তোকে অনেক হাঁটাহাঁটি করতে হয়, রোদ–জল সইতে হয়৷ সেদিন গোটু থেকে সুগিন্দে (সুগন্ধ্যা) হয়ে চন্নগর যাবার পথে তোকে রোদে জলে নাস্তানাবুদ* হতে হয়েছিল৷ তোর দুঃখু দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল৷ তোর যজমানকে বলিস, তোকে যেন একটা আধুনিক মডেলের সাইকেল আর ভাল জাতের একটা ছাতা দেয়৷ তুই তো মায়েরই সন্তান৷ তোকে সাইকেল, ছাতা দিলে মা সন্তুষ্ট হবেন৷

মা আমায় আরও বললেন–তোর যজমানকে বলিস দু’টো জিনিসই চন্নগর গঞ্জেই পাওয়া যাবে৷ এজন্যে কলকাতা দৌড়ুতে  হবে না৷ আর গঞ্জে যখন যাচ্ছেই তখন সের পাঁচেকের মত গঞ্জের নামজাদা গজাও যেন নৈবিদ্যিতে দিয়ে দেয়৷ তাতে নৈবিদ্যির শোভা বাড়বে...... ৰেশ খোলতাই হবে৷

যজমান বললে–ঠাকুর মশায় তুমি যেমনটি বলেছ তেমনটিই হবে৷

যজমান সব কিছু দিলে বটে কিন্তু মনের মধ্যে খুঁতখুঁতুনি রয়েই গেল৷ সে যে নিজের চোখে দেখেছে জল পেয়ে শামুকটি চলতে শুরু করে দিয়েছিল৷

তোমরা তা হলে গঞ্জের গজার গপ্পো বুঝে নিলে তো.....

* নেপালে উদ্ভূত নারায়ণী গণ্ডক (গণ্ডকী) নদীতে হিমালয় থেকে অনেক ছোট ৰড় বিভিন্ন আকারের নুড়ি নেবে আসে৷ সারণ জেলার একটি জায়গায় নদীগর্ভে অল্প একটু ঘূর্ণি আছে ও নদীর গভীরতাও একটু ৰেশী৷ নুড়িগুলি তারই আশেপাশে এসে জড়ো হয়৷ সুদূর নেপাল থেকে আসতে আসতে পারস্পরিক ঘাত–প্রতিঘাতে নুড়িগুলি একটি বিশেষ আকার প্রাপ্ত হয়৷ কতকটা গোলাকার কিন্তু ঠিক গোলাকারও নয়৷ একটু নড়বড়ে৷ প্রাচীনকালে দেশে যখন মহাযানী ক্ষৌদ্ধমতের প্রাধান্য ছিল সে যুগের ক্ষৌদ্ধরা শূন্যবাদের প্রতীক হিসেবে সেই কতকটা শূন্যের

মত দেখতে শিলাখণ্ডকে বুদ্ধরূপে পূজা করত ৷ সারণ জেলার শালগ্রাম নামক  গ্রামটির কাছে পাওয়া যেত বলে শিলাখণ্ডগুলিকে বলা হত শালগ্রাম শিলা৷ পরবর্তীকালে....শঙ্করাচার্যের পরে.....মহাযানী ক্ষৌদ্ধমত, শাঙ্কর শৈব মতে বা ক্ষ্রাহ্মণ্য  ধর্মের মধ্যে মিলেমিশে যায়৷ সেই সময় বুদ্ধকেই বিষ্ণুর অবতার রূপে স্বীকার করে সমীকরণের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলা হয়৷

কবি জয়দেব তাঁর দশাবতার স্তোত্রে  বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে বর্ণনা করে লিখলেন–

          ‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ্ শ্রুতিজাতং৷

          সদয়হূদয়দর্শিতপ্৷

          কেশবধৃত বুদ্ধশরীর, জয় জগদীশ হরে৷৷’’

বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার রূপে স্বীকার করলেন বটে কিন্তু শ্লোকটিতে মনের খুঁতের কথাটিও ব্যক্ত করে দিলেন৷ শ্লোকটির মানে হচ্ছে–‘‘এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে বেদবিহিত যজ্ঞবিধিকে তুমি নিন্দা করেছিলে– অহো অহো কারণ পশুহত্যা দেখে তোমার হূদয় দ্রবীভূত হয়েছিল৷ হে বুদ্ধরূপধারী নারায়ণ, আমি তোমাকে নমস্কার করছি৷’’

বুদ্ধত্বের প্রতীক শালগ্রাম শিলাকে সে সময়কার মানুষ বিষ্ণু বা নারায়ণের প্রতীক রূপে পুজো করতে শুরু করে দিলে৷ অর্থাৎ শালগ্রাম শিলা বুদ্ধশিলা থেকে নারায়ণ শিলা হয়ে গেল৷