গণতন্ত্রের বেদীতে ফ্যাসিষ্ট হুংকার আক্রান্ত শীর্ষ আদালত

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

দলীয় স্বার্থে ও বিরোধী পক্ষকে হেনস্থা করতে সরকারী এজেন্সীর অপব্যবহার পূর্বতন সরকারও করেছে৷ কিন্তু বর্তমান সরকার দলীয় ক্যাডারে পরিণত করেছে সরকারী এজেন্সীকে৷ বিচার বিভাগকেও কব্জা করতে উঠে পড়ে লেগেছে৷ এই কাজে শাসক দল বিক্ষিপ্তভাবে সফল হলেও এখনও শীর্ষ আদালত বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্ভীকভাবে চলছে অন্তত চলতে চাইছে৷ শাসক দলের সেটাই নাপসন্দ্‌৷

পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন অবিজেপি শাসিত রাজ্যের রাজ্যপালরা বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখেছেন৷ এই নিয়ে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে--- রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিল আটকে রাখতে পারেন না৷ তিন মাসের সময় সীমা নিদ্ধারণ করে দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট৷ এর বেশি সময় বিল আটকে রাখতে পারবে না৷ এতেই শাসকদলের গোঁসা৷ এক সাংসদ সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংঘাত তৈরীর প্ররোচনা দেবার অভিযোগ আনেন৷ নির্বাচনী প্রচারে কারা ধর্মীয় সংঘাত তৈরীর প্ররোচনা দেয় দেশের সচেতন নাগরিক তা জানেন৷ তবে গণতন্ত্রের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদের কথা হলো স্বয়ং উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকরের সুপ্রীম কোর্টের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্য৷ তিনি বলেছেন---‘যারা নির্বাচিত নয়, তারা সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, আইনসভাকে নির্দেশ দেবে তা হতে পারে না৷ সুপ্রিম কোর্টের কোন দায়বদ্ধতা নেই, সেটা আছে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের৷

ধনকরের নিশ্চই জানা আছে রাজ্যপালরা কেউ নির্বাচিত প্রতিনিধি নন৷ রাজ্যপালরা কেন্দ্রীয় শাসকদলের বশংবদ রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত৷ রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিও প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রপতি উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন৷ তবে উপরাষ্ট্রপতি ওইখানেই থেমে থাকেননি৷ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন---সংবিধানে অন্যকোন সংস্থার কথা বলা হয়নি৷ যারা পার্লামেন্টের ওপর খবরদারী করবে৷

ধনকর একসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন৷ এখন প্রশ্ণ উঠতে পারে বিধানসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পাশ হওয়া বিল কেন্দ্রের মনোনীত রাজ্যপালরা কী আটকে রাখতে পারেন৷

গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে---জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার৷ সত্যিই কি সরকার জনগণের হয়৷ ভারতীয় সংবিধানের ছিদ্রপথ দিয়ে অসৎ নীতিহীন কপটাচারী অপরাধ জগতের লোকেরাও সংসদে বিধানসভায় নির্বাচিত হয়৷ সার্থক গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো রাষ্ট্রের একান্ন শতাংশ নাগরিককে শিক্ষিত হতে হবে ও শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে৷ এই সচেতন নাগরিকদেরই বোট দেবার অধিকার থাকা উচিত৷ কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে সাবালোক প্রাপ্ত হলেই বোটাধিকার পেয়ে যায় তাঁরা শিক্ষিত ও সচেতন হোক বা না হোক৷ সংবিধানের এই ত্রুটির ফাঁক দিয়েই অসৎ ধূর্ত লোকেরা সাধারণ বোটারদের বোকা বানিয়ে সংসদে বিধানসভায় ঢুকে শাসন ক্ষমতা দখল করে বসে৷ একবার ক্ষমতায় বসতে পারলে আর গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির ধার ধারে না৷ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে যে কোন উপায় ক্ষমতা ধরে রেখে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করে৷ বাকচাতুর্য্যের দ্বারা, অর্থশক্তি ও বাহুবলের দ্বারা অচেতন জনগণকে বশ করে নির্বাচনে জয়লাভ করে৷ তাই গণতন্ত্রকে সার্থক করে তুলতে হলে জনগণের শিক্ষা ও সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চেতনা অন্যতম শর্ত৷

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র স্বৈরাচারের পথে যাচ্ছে৷ স্বৈরাচারী শাসকরা আইন বিভাগ, বিচারব্যবস্থা,আমলা প্রশাসন,গণমাধ্যম সব কিছুকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়৷ গত ১২ বছরে মোদি সরকার এই কাজে অনেকটাই সফল৷ ব্যতিক্রম শীর্ষ আদালত৷ তাই শাসকের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ শীর্ষ আদালতকে৷ আশার কথা শীর্ষ আদালত শাসকের হুমকির কাছে মাথানত করছে না৷ শীর্ষ আদালতের এক বিচারপতি বলেছেন বিচার ব্যবস্থার উপর ক্রমাগত আক্রমণ হচ্ছে৷ হোক, তবু আমরা এসবে উদ্বিগ্ণ নই৷