গণতন্ত্রের পাঠ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক পাঠ হলো জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৭৭বছর পরেও দেশের জনগণ ও দেশের নেতা মন্ত্রীরা গণতন্ত্রের এই প্রথম পাঠ বিষয়ে কতটা সচেতন! প্রথম কথা সার্থক গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে জনগণের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা৷ কিন্তু আজও ভারতের ৮০ শতাংশ মানুষের এই চেতনা নাই৷ জনগণের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে জনগণকে নানা প্রলোভনে প্রভাবিত করে একবার ক্ষমতায় বসতে পারলেই প্রাগৈতিহাসিক সমাজ ব্যবস্থার---‘‘জোর যার মুল্লুক তার’’ পাশবিক নীতিকে আঁকড়ে ধরে৷

দেশে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে৷ সব দলই প্রচারে ঝাঁপিয়ে  পড়েছে৷ প্রচারে নেতারা যেভাবে যে ভাষায় বিপক্ষ দলকে হুমকি দিচ্ছে তাতে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে গণতন্ত্রের মুখোশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাগৈতিহাসিক পাশবিক নীতিতেই আস্থা রাখে৷ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের ভাষাতেও সৌজন্য ও শালীনতার অভাব৷ যেন তেন প্রকারে জনগণকে প্রভাবিত করে দলের পক্ষে বোটটা আদায় করাই লক্ষ্য৷ সেখানে নীতি নিয়ম মানার কোন বালাই থাকে না৷

প্রায় দু’মাস ধরে ম্যারাথন নির্বাচন দেশের সব উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সিকেয় তুলে, ছাত্র-ছাত্রাদের শিক্ষার অঙ্গণে তালা ঝুলিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর বুটের আবাজে এ কেমন গণতান্ত্রিক নির্বাচন! বিশ্বের বৃহত্তম গর্বিত গণতন্ত্রের এ কী হাল? নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ণ ওঠে৷

স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই দেশের রাষ্ট্রনেতারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জনগণকে দেয়নি৷ শব্দ দুটোর বিস্তৃত মানে বোঝার তাগিদও জনগণ অনুভব করেনি৷ তাদের কাছে ইংরেজ দেশ ছেড়ে যাওয়াটাই স্বাধীনতা, পাঁচবছরে একবার লাইনে দাঁড়িয়ে বোট দেওয়াটাই গণতন্ত্র৷ আর আজ তো দেশের কল্যাণ দূরে থাক নিজেদের  ভালোটা বোঝার মত ক্ষমতাও জনগণের নেই৷

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজনৈতিক দল ও ধনিক শ্রেণীর অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে৷ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়ে জনগণের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে ধনিক  শ্রেণী রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছেন৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের কঠোর পদক্ষেপে নির্বাচনী বণ্ড প্রকাশ হওয়ায় ধনিক শ্রেণী ও রাজনৈতিক  দলগুলোর আঁতাত আরও স্পষ্ট হয়েছে৷

ভারতীয় সংবিধানের কতকগুলি ত্রুটির জন্যে স্বাধীনতার ৭৭বছর পরও ভারত আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি৷ প্রথমত জনগণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়ে অসচেতনতা, পরিণতিতে রাজনৈতিক দলগুলির মত ও কর্মসূচী কতটা জনসাধারণের স্বার্থের অনুকুলে সে বুঝবার ক্ষমতা জনগণের নেই৷ দ্বিতীয়ত নির্বাচনের সময় ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে নির্বাচনী ইস্তাহার দলগুলি প্রকাশ করে তারমূল্যও জনগণ বোঝে না৷ ক্ষমতায় বসার পর রাজনৈতিক দলগুলোর আর নির্বাচনী ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কোন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা থাকে না৷ তাই শুধু অন্তঃসারশূন্য ভাষণ আর প্রচারের ঢক্কা নিনাদে জনগণকে প্রভাবিত করে একবার ক্ষমতায় বসতে পারলেই প্রাগৈতিকহাসিক সমাজের শাসকের চেহারা ক্রমশঃ প্রকাশ হতে থাকে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের আরও মারাত্মক ত্রুটি হলো জনসমর্থনের নিরিখে নয়, আসন সংখ্যার নিরিখে পঞ্চাশ ভাগের বেশী হলেই সরকার ঘটন করা যায়৷ হয়তো সেই দল পঞ্চাশ ভাগের অনেক কম বোট পেয়েছে৷ ফলে ভারতবর্ষে প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার তৈরী হয় না৷ সংখ্যালঘু সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর খবরদারি করে৷ বোটদান ব্যবস্থাতেও ত্রুটি আছে৷ সাবালোক হলেই বোট দেবার অধিকার পেয়ে যায় সে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়ে সচেতন হোক বা  না হোক৷ ফলে অনেক অযোগ্য অসৎ প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পারে৷ তাই বোটাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে বোটারের শিক্ষাগতমান, রাজনৈতিক চেতনা ও জনগণের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা থাকতেই হবে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের এই অজস্র ত্রুটির ছিদ্র পথে জনগণকে ঢাল করে অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে হাত করে শাসন ব্যবস্থা কব্জায় রেখেছে ধনিক শ্রেণী৷ সুসংহত গণতন্ত্রের মুখ্য বিভাগগুলি অর্থাৎ আইন বিভাগ শাসন-বিভাগ, বিচার ও হিসাব-পরিক্ষণ বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়েও নানা বিরূপ সমালোচনার শিকার বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র৷ ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রথম পাঠেই গলদ৷ জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজিপতিদের দ্বারা, পুঁজিপতিদের জন্য, পুঁজিপতিদের শাসন৷ রাজনৈতিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যাদের নেই তাদের দ্বারা নির্বাচিত শাসক দানবতন্ত্রে পরিণত হতেই পারে৷ তারই ছায়া এই নির্বাচনে আরও বেশী প্রকট হচ্ছে৷