রাজনৈতিক খুন-সংঘর্ষ পশ্চিমবঙ্গে নিত্যদিনের ঘটনা৷ মূলত বামপন্থীদের হাত ধরে এই খুনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে৷ পাঁচের দশকের ঘটনা---হাওড়া জেলার বাগনান থানার বাইনান গ্রামের গাঙ্গুলী পরিবারের বড়ছেলে বিমল গাঙ্গুলী এলাকার জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা৷ তারই একভাই অমল গাঙ্গুলী তখন রাজ্য বিধানসভার বিধায়ক সিপিআই দলের৷ সেই সময় বিমল গাঙ্গুলী খুন হয়৷ অভিযুক্ত অমল গাঙ্গুলী ও আরও কয়েকজন সিপি আই কর্মী৷ তখনও চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দালালী করা নিয়ে কম্যুনিষ্ট পার্টীতে বিভাজন হয়নি, সিপিএম প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ পরবর্তীকালে অমর গাঙ্গুলী ও তার অন্য ভাইরা স্বীকার করে যে বিমল গাঙ্গুলীকে খুন সিপিআই করেছে৷ অমল গাঙ্গুলী প্রমাণ অভাবে আদালত থেকে মুক্তি পেলেও বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পাননি৷ তাই তিনি পার্টি ছেড়ে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের অর্থ সাহায্যে বাগনানে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে বরুন্দো গ্রামে আনন্দ নিকেতন নামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন৷ তা আজও আছে৷
পশ্চিমবঙ্গে সংঘটিত খুনের রাজনীতি শুরু হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে সিপিএমের নেতৃত্বে, অজয় মুখার্জীর বাঙলা কংগ্রেসের হাত ধরে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর৷ জ্যোতি বাবুর হাতে ছিল স্বরাষ্ট্র দপ্তর৷ সেই সময় বর্ধমানে সাঁইবাড়ীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, ও আনন্দনগরে পাঁচ জন মার্গের সন্ন্যাসীকে খুন করে কম্যুনিষ্টরা৷ ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর খুন সন্ত্রাস রাজনীতির বাইরে সামাজিক ও পারিবারিক পরিধিতে বিস্তার করে৷ আজ গ্রাম দখলের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে খুন সন্ত্রাস ও রক্ত ঝরছে এর দায় শুধু শাসক দলের ঘাড়ে চাপিয়ে বিরোধীরা ধোয়া তুলসী পাতা সেজে বসে থাকতে পারে না৷ সিপিএমের ৩৪ বছরের খুন সন্ত্রাস অধীর চৌধুরীর মত নেতারা ভুলে যেতে পারে কিন্তু হাজার হাজার কংগ্রেসী পরিবার ভুলবে কি করে? আমতার কেন্দুয়া সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার কংগ্রেসী পরিবার সিপিএমের ৩৪ বছরের সন্ত্রাসের ক্ষত বয়ে বেড়াবে সারাজীবন৷
পৃথিবীতে রাষ্ট্র পরিচালনার যত প্রকার ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তা নির্ভর করে নেতৃত্বের গুণাবলীর উপর৷ বলতে দ্বিধা নেই, আজ পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসৎ ধান্দাবাজ দুর্নীতি পরায়ন নেতাদের ক্ষমতা দখলের এক নিকৃষ্ট উপায়৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতির ছিদ্র দিয়েই রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রবেশ ঘটেছে, অসৎ নেতৃত্বের অনুপ্রবেশ ঘটেছে৷ যাদের কাছে রাজনীতি জনকল্যাণের মহৎ কোন আদর্শ নয়, ক্ষমতাভোগ ও অসৎ উপায়ে অর্থউপার্জনের সহজতম পথ৷ অবশ্যই এর পিছনে আছে পুঁজিবাদী শোষকরা৷ যাদের লক্ষ্য শোষনের পথ মসৃন রাখতে অর্থনীতির কেন্দ্রীয়করণ ও দুর্নীতির ও খুন সন্ত্রাসের বিকেন্দ্রীকরণ৷ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই দুর্নীতিকে পৌঁছে দেওয়া যায় গ্রামস্তর পর্যন্ত৷ পুঁজিবাদী শোষকরা খুব সূক্ষ্মভাবে অসৎ নেতাদের মাধ্যমে হিংসা ও দুর্নীতিকে গ্রামস্তরে পৌঁছে দিয়েছে, গ্রামস্তরের যে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা৷
পৃথিবীতে যে কোন শোষন, দুর্নীতি অত্যাচার ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে সরব হয়, সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় মধ্যবিত্ত ছেলেরা৷ সেই ছেলেদের মধ্যে যদি হিংসা ও দুর্নীতির বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত রাখা যায়, অর্থাৎ সরষের মধ্যে যদি ভূত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই সরিষার আর ভূত তাড়ানোর ক্ষমতা থাকে না৷ পুঁজিবাদী শোষক ও অপগণ্ড রাজনৈতিক নেতাদের আর্থিক প্রলোভনের কুটিল চালে পশ্চিম বাঙলার মধ্যবিত্তের আজ সেই দশা৷ তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইতে নেমেছে অবুঝ মধ্যবিত্ত ছেলের দল৷ একদিকে বাঙলার খনিজ সম্পদ , বনজ সম্পদ, জলজ সম্পদ লুন্ঠিত হয়ে চলে যাচ্ছে আর পঞ্চায়েতে যৎসামান্য অর্থের লোভে গ্রাম দখলের লড়াই গণতন্ত্রের বেদীমূলে হিংসার উৎসবে পরিণতি হয়েছে৷
- Log in to post comments