গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ড পরিকল্পনা ও এন.আর.সি প্রয়োগ রুখতে ত্রিপুরার সমস্ত বাঙালী ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন

লেখক
গৌরাঙ্গ রুদ্রপাল
বাঙালী জাতিসত্ত্বা আজ এক চরম বিপদের সম্মুখীন৷ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রপথিক বাঙালীরাই স্বাধীনোত্তর ভারতে দেশভাগের বলি৷ দেশের অগ্রগতির অন্যতম কাণ্ডারী হল বাঙালী৷ অথচ দুর্ভাগ্য হল শোষণ, বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী বাঙালীকে ইংরেজরা যেমন কোনদিন সহ্য করতে পারেনি তেমনি পশ্চিমী বেনিয়া প্রভাবিত দেশীয় নেতৃবৃন্দ ও কেন্দ্রের শাসকবর্গও বাঙালীকে সহ্য করতে পারছেনা৷ তাই স্বাধীনদেশে বাঙালীর প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও দেশভাগের বলি উদ্বাস্তু বাঙালীদের পুনর্বাসন সমস্যার আজও সমাধান হয়নি৷ বাঙালীর প্রতি বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়৷ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে নিজেদের চেষ্টায় বাঙালীরা যখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে একটু বাঁচার সংস্থান করার চেষ্টা করছে তখন ত্রিপুরার মতো রাজ্যে জমি ফেরৎ, ৬ষ্ঠ তপশীল আইন, টিএনভি চুক্তি, অসমে রাজীব-অগপ চুক্তি, এনআরসি, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ড, মেঘালয়ে ইনারলাইন পারমিট ইত্যাদি করে বাঙালীর ভূমির অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার থেকে শুরু করে সবকিছুই কেড়ে নেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ উল্লেখ্য যে অসমে, ইতোমধ্যেই এন.আর.সি আইন প্রয়োগ করে প্রায় ২০ লক্ষ বাঙালীকে বিদেশী তথা রাষ্ট্রহীন চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ সেখানে ৯০ হাজারের অধিক বাঙালীকে ডিটেনশন ক্যাম্প নামক নরকে পাঠানোর জন্যে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাম্প বানানো হয়েছে৷ ত্রিপুরাতে দাবী উঠছে ৫১ সালকে ভিত্তি বছর ধরে এন.আর.সি আইন চালু করার৷  বাঙালীরা ত্রিপুরার ভূমিপুত্র হলেও এন.আর.সি কার্যকর হলে রাজ্যের অধিকাংশ বাঙালীই যে বিদেশী তথা রাষ্ট্রহীন চিহ্ণিত হয়ে সাংবিধানিক অধিকার হারাবে বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এখন ত্রিপুরায় বাঙালীদের জন্যে আর একটি বড় বিপদ হলো--- গ্রেটার তিপ্রল্যাণ্ড৷ সবার আশঙ্কা, গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ডের নামে এডিসি এলাকাকে সম্প্রসারিত করে গোটা ত্রিপুরা রাজ্যে নাগাল্যাণ্ডের ধাঁচে সর্বময় কর্তৃত্ব উপজাতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে৷ বর্তমানে রাজ্যের যে তিনচতুর্থাংশ জায়গা নিয়ে এডিসি, সেখানে বাঙালীদের ভূমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি থেকে শুরু করে কোন কিছুর অধিকার নেই৷ শুধু রয়েছে উগ্রবাদীদের ভয়, নিরাপত্তাহীনতা৷ গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ড হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, যে একতাবদ্ধ না হলে বাঙালীরা ধন, মান, জীবন রক্ষার্থে ত্রিপুরা ছাড়তে বাধ্য হবে৷ নতুন উপজাতি ভিত্তিক দল ‘তিপ্রামথা’র উত্থান ও এডিসি দখলের পর থেকেই হামলা, হুজ্জুতি ও গো-ব্যাক্‌ বাংলাদেশীর মতো উত্তেজক সাম্প্রদায়িক শ্লোগানের মধ্য দিয়েই যার কিছু কিছু লক্ষণ ত্রিপুরাতে দেখা দিতে শুরু করেছে৷ বর্তমানে রাজ্যে যেভাবে উগ্রবাদী তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ১৯৮০-এর জুনের গণহত্যার ভয়ও মানুষকে এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ এমতাবস্থায়, সবকিছু দেখে শুণেও শুধুমাত্র সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে  বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের পক্ষ হয়ে একটি কথাও বলছে না বরং ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যে সাম্প্রদায়িক দল তিপ্রামথার সঙ্গে জোট গড়ার চেষ্টায় মত্ত হয়ে আছে৷ ত্রিপুরা বাঙলার অঞ্চল, বাঙালীরাই হল এরাজ্যের ভূমিপুত্র৷  বাঙালীদের আর্থিক, দৈহিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক শ্রমেই ত্রিপুরা গড়ে উঠেছে৷ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর ‘মাণিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস ‘গ্রন্থে লিখেছেন--- ত্রিপুরা বলতে কোন নাম ছিল না এবং বর্তমান ত্রিপুরা ছিল পূর্ববাংলা বা সমতট বা হরিকেল রাজ্যের অংশ যাদের ব্যবহৃত মুদ্রা ত্রিপুরায় পাওয়া গেছে৷ একসময় ত্রিপুরার নাম ছিল শ্রীভূম৷ বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন--- ‘ত্রিপুরার রাজারা মূলতঃ মঙ্গোলীয় এবং বাঙালীদের সংস্পর্শে  এসে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হয়েছেন৷’ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘বাংলা ও বাঙালী’ গ্রন্থে বলেছেন--- মুচাংফার নেতৃত্বে এক দল টিপ্‌রা উপজাতি বর্তমান আরাকান, শান অঞ্চল থেকে ৫৫০ বছর আগে দুর্ভিক্ষ তাড়িত হয়ে বাঁচার জন্যে তারা ত্রিপুরাতে আশ্রয় গ্রহণ করে৷ ত্রিপুরার একজন প্রখ্যাত মুদ্রা গবেষক ও ইতিহাস বিশ্লেষক প্রয়াত জহর আচার্যী প্রণীত ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৮৮ পৃষ্ঠায়  উল্লেখ আছে ---চতুর্দশ শতাব্দীর পূর্বে ত্রিপুরায় তিপ্‌রা রাজাদের রাজত্বের কোনরকম প্রমান আজও মেলেনি বরং মিলেছে সমতট ও হরিকেল রাজ্যের প্রমাণ৷ যাইহোক, বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে ত্রিপুরা, জাতি-উপজাতি সকলের৷ অতীতের মতো বাঙালী-পাহাড়ীকে মিলেমিশেই সম অধিকার নিয়ে এরাজ্যে বসবাস করতে হবে৷ এমতাবস্থায়, আমাদের আহ্বান---আসুন বাঙালী বিরোধী সমস্ত শক্তিকে প্রতিহত করতে আমরা ঐক্যবদ্ধ শোষণ বিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে ‘প্রাউটে’র আদর্শে নতুন স্বয়ম্ভর ও সমৃদ্ধ ত্রিপুরা গড়ে তুলি৷