হাসি-খুশী নজরুল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বাংলা কবিতার ইতিহাসে নজরুল এক নবযুগের স্রষ্ঠা৷ বাঙালীর মর্মমূলে তাঁর কাব্য গভীরভাবে রেখাপাত করেছে৷ হাস্যরসিক হিসাবেও তাঁর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়৷ তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁদের অজানা নয় যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণমাতানো হাস্যরসের প্লাবন কি বিপুল বেগে বওয়াতে পারতেন কাজী নজরুল৷ বিপ্লবী কবির জন্মদিনে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই৷

হরিহরচন্দ্রের বাড়ীতে সভা বসেছে৷ সভায় এসেছেন অনেক জ্ঞানী গুণী৷ অনেক গায়কও আছেন, একের পর এক গেয়ে চলেছেন৷

এক সময় ডাক পড়লো এক গায়কের৷ বিশাল শরীরে তাঁর রঙের ঢেউ বইছে যেন৷ হলদে পাঞ্জাবী তাঁর গায়ে, কাঁধে গেরুয়া উড়নি--- যেন একটি বাহারী পাতা৷ পোষাক দেখলে হাসিই পায়৷ চোখ তাঁর ডাগর ডাগর, পৌরুষ-দীপ্ত চাহনি৷ মুখে নিরন্তর আন্তরিকতার হাসি৷

এহেন অদ্ভূতদর্শন গায়ক এসে বসলেন সভায়৷ হারমোনিয়াম খানা সযত্নে টেনে নিলেন দুহাতে৷ হাত জোড় করে বললেন আগের গায়কদের উদ্দেশ্যে, মাফ করবেন, আপনারা সুর,আর আমি অসুর৷

শ্রোতাদের মধ্যে একটি মৃদু হাসির ঝড় বয়ে গেলো৷ কে এই রসিক গায়ক? কাজী নজরুল ইসলাম৷ তিনি যেমন নিজেও খুব হাসতেন তেমনি অপরকেও হাসাতে পারতেন৷

নজরুল বাড়িতে সব সময় হৈ হল্লায় মেতে থাকতেন৷ তিনি বাড়িতে কেমন হাসি ঠাট্টা, বালক সুলভ চপলতায় মেতে থাকতেন ‘খুশির আবেগে পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে কিভাবে আত্মীয়রূপে বরণ করে নিতেন তার নির্দশন পাই গোলাম মোস্তাফার একটি কবিতায়৷

নজরুল তখন থাকতেন হুগলীতে৷ গোলাম মোস্তাফা একদিন গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে৷ তিনি নজরুলকে তাঁর বাড়িতে যে অবস্থায় দেখেছিলেন তার একটি ছবি এঁকেছিলেন কবিতায়---

‘‘কাজী নজরুল ইসলাম

বাসায় একদিন গিছলাম৷

ভায়া লাফ দেয় তিন হাত

হেসে গান গায় দিন রাত৷

প্রাণে ফূর্তির ঢেউ বয়

ধরায় পর তার কেউ নয়৷’’

এর উত্তরে নজরুল কি বললেন জানেন? সেও এক হাসির ব্যাপার৷ বললেন---

‘‘গোলাম মোস্তাফা

  দিলাম ইস্তফা৷’’

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়িতে তাঁর প্রথম আলাপ হয় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে৷ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তখন থাকতেন কোলকাতার চিংড়িঘাটা অঞ্চলে৷ আর নজরুল কলেজষ্ট্রীটে৷ নজরুলের সঙ্গে সেদিন ছিলেন আফজল উল হক৷ তিনজনে আলাপ করতে করতে পৌঁছলেন চিংড়িঘাটায় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে৷

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, চলুন, আপনারা পথ চিনতে পারবেন না, আমি এগিয়ে দিয়ে আসি৷

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ কলেজষ্ট্রীটে একেবারে নজরুলের বাড়ি পর্যন্ত এলেন৷

তখন নজরুল বললেন, চলুন এবার আপনাকে আমরা এগিয়ে দিয়ে আসি৷

অবাক হলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ৷ বললেন, অনেক রাত হয়েছে যে৷

নজরুল মুচকি হেসে বললেন, তাতে কি হয়েছে--- পথ তো আমি চিনে ফেলেছি৷

বাড়িতে অতিথি এলে তাঁর স্ফূর্তি দেখে কে৷ গান-বাজনা, ঠাট্টা তামাসা করে সারাদিন কাটাতেন৷ রাতেও অতিথিদের নিস্তার নেই৷ কেউ যদি চিন্তিত হয়ে বলেন, লাস্ট ট্রেন কটায়?

‘‘দে গরুর গা ধুইয়ে৷’’ নজরুলের উত্তর, লাস্ট ট্রেনের কথা লাস্ট ট্রেনকে জিজ্ঞেস করো৷

তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘‘প্রবাসী’’৷ নজরুল ওটাকে ঠাট্টা করে বলতেন প্রকৃষ্টরূপে বাসি৷

তাঁকে যিনি ‘স্বাভাবিক অবস্থায় দেখেছেন তিনি ভুলতে পারেননি তাঁর হাসির ফোয়ারা---প্রাণ মাতানো কথাবার্র্ত৷ তাঁর সাহিত্য সাধনা যেন ঝর্ণার মতো বয়ে চলেছিল---কোন বাধা না মেনে৷ সব সময় যেন তিনি রসে ভরপুর থাকতেন৷ জীবনটা তিনি কাটিয়েছেন কুসংস্কারহীন আনন্দের পথে৷