তোমরা জান, অন্যান্য সকল বিষয়ে যত যত্নই নেওয়া হোক না কেন, তরকারিতে লবণ ঠিক মত না দিলে তা কখনও সুস্বাদু হয় না৷ তেমনই সসীম ও অসীমের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের যাবতীয় প্রয়াস বিফল হয় যদি ভক্তির অভাব ঘটে৷
যেমন কর্মের ব্যাপারেই দেখ না৷ সাধক হয়তো কর্মযোগী কিন্তু তার মধ্যে যদি ভক্তি না থাকে তাহলে তার যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে পড়ে৷ কর্মের সঙ্গে ভক্তি সংযুক্ত থাকলে, ঈশ্বরপ্রেম যুক্ত থাকলে তবেই কর্ম গৌরবোজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ নইলে কর্ম ব্যাপারটা একান্ত যান্ত্রিক হয়ে পড়ে৷ আর সেক্ষেত্রে কর্মসাধনার গোড়ার দিকে যদিও কর্মী কিছুটা মানসিক অন্তর্মুখিনতা অর্জন করে পরের দিকে সেটাও লোপ পেয়ে যায়, আর তার ফলস্বরূপ জীবন পথে চলতে গিয়ে সে একান্তই বহির্মুখী হয়ে পড়ে অর্থাৎ তার মানবীয় অস্তিত্বটাই যন্ত্রবৎ হয়ে পড়ে৷ তাই কেবল কর্মের দ্বারা মানুষ পরম লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে না যদি সেই কর্মের সঙ্গে ভক্তি বা ঈশ্বরপ্রেম সংযুক্ত না থাকে৷
এখন দেখা যাক, তপস্বী সাধকের ক্ষেত্রে জিনিসটা কী রকম দাঁড়ায়৷ তপস্যা ব্যাপারটা হ’ল স্বল্পকালের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে স্বেচ্ছায় ক্লেশবরণ৷ এখন, তপস্যা করতে গিয়ে যদি সাধকের মনে পরমপুরুষের প্রতি প্রেম না থাকে তাহলে তপস্যা ব্যাপারটাই নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়৷ এ ধরনের তপস্যা শুধু সময়ের অপচয় মাত্র৷ ভক্তি–প্রেমবর্জিত তপস্যা তো শুধু অনর্থক কালক্ষেপ৷ তাতে সাধকের দেহ ও মনের ওপর একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে৷ তার ফল অবশ্যই শুভপ্রদ হয় না৷
যোগ কী? যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্৷ মন বা চিত্তের সকল বৃত্তির নিরুদ্ধাবস্থাই ‘যোগ’ নামে অভিহিত হয়৷ এখন এই নিরোধকালে যদি পরমপুরুষের প্রতি অন্তরে প্রেম–ভক্তি থাকে সেক্ষেত্রে সমস্ত নিরুদ্ধবৃত্তি পরমপুরুষেই সমাহিত হয়ে যায়৷ ধর, একজন মস্ত বড় যোগী৷ কিন্তু যদি তাঁর অন্তরে ইষ্টের প্রতি ভালবাসা না থাকে, তবে যাবতীয় নিরুদ্ধ বৃত্তি স্থূল জড়ে পর্যবসিত হয়ে যায়৷ তার অর্থ, তার সূক্ষ্ম মানব অস্তিত্বটাই বালুকণা ইঁট–কাঠ–লোহার মত স্থূল হয়ে পড়ে৷ ভাব তো কী নিদারুণ অধোগতি কী শোচনীয় অধঃপতন এই যে বিশেষ প্রকার যোগ যাতে সাধকের মনে পরমপুরুষের প্রতি কোন প্রেম–প্রীতি নেই তাকে সংসৃক্তে বলে ‘হঠযোগ’৷ মানুষের উন্নতির পক্ষে এ ধরনের হঠযোগ মারাত্মক বিপজ্জনক৷
‘হ’ আর ‘ঠ’ মিলে ‘হঠ’৷ সূর্য নাড়ী বা ইড়া নাড়ীর দ্যোতক এই ‘হ’ ধ্বনিটি, আবার স্থূল শক্তির বীজমন্ত্রও এই ‘হ’ অক্ষরটি৷ আর ‘ঠ’ হ’ল চন্দ্রনাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ীর দ্যোতক, সেই সঙ্গে মানস শক্তির বীজমন্ত্রও এই ‘ঠ’ অক্ষরটি৷ তাই ‘হঠ’ শব্দের তাৎপর্য হ’ল স্থূল শক্তির প্রয়োগের দ্বারা মনকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ সাধারণতঃ যখন আচম্বিতে বা আচমকা কোন ঘটনা ঘটে, আমরা বলে থাকি ব্যাপারটা ‘হঠাৎ’ ঘটে গেল (হঠেন কুরুতে কর্ম)৷ স্বভাবতই কোন হঠযোগী মুক্তি–মোক্ষ লাভ করতে পারেন না৷
আবার ধর, কোন একজনের ঈশ্বরের প্রতি বিশেষ ভক্তি–প্রেম নেই কিন্তু সে মস্ত জ্ঞানী, বড় বুদ্ধিজীবী৷ সবাই মানে, মানুষটি সত্যিই বড় জ্ঞানী, এটা–ওটা অনেক কিছুই সে জানে বোঝে৷ কিন্তু পরমাত্মাবর্জিত জ্ঞান তো কলার খোসার মত৷ সেটা আসল কলা নয়, কলার খোসা মাত্র৷ তা থেকে তো আর আসল কলার স্বাদ পাওয়া যাবে না৷ তাই সেই মানুষটির আহূত জ্ঞান পরাবিদ্যা নয়–অপরাবিদ্যা৷ তার আপেক্ষিক জ্ঞান তো স্থূল জড়জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ এই স্থূল জড়বাদী জ্ঞান গত শতাব্দীতে মানুষের সমাজের প্রভূত ক্ষতি করেছিল৷ সারা মানব সমাজকে বিভ্রান্ত করেছিল, মানুষকে অমানুষে, পশুতে পরিণত করেছিল৷ সত্যিই,এই সব জড়বাদী দর্শনগুলোর অনুগামীরা পশুকেও শোষণের হাত থেকে রেহাই দেয়নি৷
‘প্রেয়স্ক্রা যা বুদ্ধিঃ সা বুদ্ধিঃ প্রাণঘাতিনী৷
শ্রেয়স্ক্রা যা বুদ্ধিঃ সা বুদ্ধিঃ মোক্ষদায়িনী৷৷’
বলা হয়ে থাকে, পরা–পরা সব বিদ্যাই বিশাল ক্ষীরসমুদ্রের মত৷ এখন দুগ্ধসমুদ্রকে মন্থন করে আমরা কী পাই? আমরা পাই মাখন ও ঘোল৷ এই রকম দুগ্ধসমুদ্রকে মন্থন করে ভক্ত পায় মাখনের ভাগটা আর জ্ঞানীর জন্যে পড়ে থাকে অসার ঘোল অংশটা৷ বুদ্ধিজীবীরা, জ্ঞানীরা ঘোলের মালিকানা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে মরে৷ আবার শেষ পর্যন্ত সেই ঘোলটুকুও তারা ভোগ করতে পায় না কারণ ভাগাভাগি করতে গিয়ে মূল্যবান সময়ের অযথা অপচয়ের ফলে সেই ঘোলটুকুও খারাপ হয়ে যায়, বিস্বাদ হয়ে যায়৷
ভক্তির আবার প্রকারভেদ আছে৷ তাদের মধ্যে মুখ্য হ’ল তিন প্রকারের ভক্তি–তামসিকী, রাজসিকী ও সাত্ত্বিকী ভক্তি৷ তামসিকী ভক্তি মানে তমোগুণী ভক্তি৷ বস্তুতঃ তামসিকী ভক্তি ভক্তিই নয়, কারণ এই ধরনের ভক্ত শত্রুর নিধন কামনা করে৷ এক্ষেত্রে পরমপুরুষ যেহেতু এই ধরনের ভক্তের অভীষ্ট নন, তাই তারা কমিস্মনকালেও পরমপুরুষকে লাভ করবে না৷
রাজসিকী ভক্তি মানে রজোগুণী ভক্তি৷ এই ধরনের ভক্ত পরমপুরুষের কাছে জাগতিক ধনসম্পদ প্রার্থনা করে৷ তাতে তারা ধনসম্পদ পেতেও পারে, নাও পারে৷ তবে এটা ঠিক যে তারা পরমপুরুষকে পাবে না কেননা পরমপুরুষ তো তাদের ধ্যেয় নন৷
সাত্ত্বিকী ভক্তির ক্ষেত্রে লক্ষ্য হ’ল পরমপুরুষ৷ এক্ষেত্রে সাধকের একমাত্র প্রার্থনা হ’ল পরমপুরুষ সম্প্রাপ্তি আর তাই মানুষের যাবতীয় মানবিক কর্মৈষণার চরম ও পরম লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ (পটনা, ১৩ই সেপ্ঢেম্বর ১৯৭৮)