‘ব’ বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট গল্প মনে পড়ল৷ তোমরা বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দেখেছ নিশ্চয়, সারি সারি নাপিত বসে রয়েছে৷ যার দাড়ি কামাবার আছে সে উবু হয়ে বসে পড়ছে, আর নাপিত–ভায়া তার ‘ব’–কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে৷ সময়ে সময়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলছে–এই নিয়ে আঠাশটা দাড়ি হ’ল৷ আর দু’টো দাড়ি হলেই বাড়ী ফিরছি৷ রেস্তোরাঁয় যেমন শুণতে পাও, ‘ওই দিকে চারটে চা নিয়ে যা’৷ যাই হোক্, কোনো বনেদী লোক এসে পৌঁছুলে নাপিত–ভায়া তখন তাকে বসবার জন্যে ইট অফার করত৷ এই ইটে বসে দাড়ি কামানোকে বলা হত ইটালিয়ান সেলুন৷
১৯৩৯–৪০ সাল অবধি দেখেছি যাঁরা উবু হয়ে বসে দাড়ি কামাতেন নাপিত–ভায়া সাধারণ ঠান্ডা জল দিয়ে তাঁদের দাড়ি কামিয়ে দিতেন আর দক্ষিণা নিতেন এক পয়সা৷ আর যাঁরা ইটালিয়ান সেলুনে বসতেন তাঁদের সাবান–মিশ্রিত গরম জল দিয়ে দাড়ি কামিয়ে দেওয়া হত৷ নাপিত–ভায়া তাঁদের কাছে প্রণামী নিতেন দু’পয়সা৷
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল গেঁজেলদের গল্প৷ যখন কোনো নবাগত, গেঁজেল হবার জন্যে শিক্ষানবিশ (এ্যাপ্রেন্টিস) হিসেবে গেঁজেল ক্লাবের সদস্য হয় তখন গোড়ার দিকে তাকে উবু হয়ে বসে গাঁজায় দম টানতে হয়৷ এই উবু হয়ে বসা অবস্থায় তাদের বলা হয় উবু–গেঁজেল বা এ্যাপ্রেন্টিস–গেঁজেল৷ তারপর গেঁজেলদের যোগ্যতার একটা পরীক্ষা হয় যাকে বলতে পারো যোগ্যতা–পরিমাপক পরীক্ষা (suitability test or efficiency test)৷ সেই যোগ্যতা–পরীক্ষায় যে উত্তীর্ণ হয় সে তখন থেকে বসবার জন্যে ইট পায়৷ ইটে বসার পর থেকে আর তাকে উবু–গেঁজেল বলা হয় না–বলা হয় ইটালিয়ান গেঁজেল৷ একবার ভাগীরথীর তীরে (ডান তীর না বাঁ তীর মনে পড়ছে না৷ ডান তীর হলে বর্ধমান জেলা, বাঁ তীর হলে নদীয়া জেলা) গেঁজেলদের সভা বসেছে একটা মাদার*(*কলকাতায় আমরা বলি মাদার, ২৪পরগণা ও মেদিনীপুর জেলায় বলে ড্যাফল৷ রাঢ়ের কোথাও কোথাও বলে ডেলো বা ডাউয়া৷ খণার বচনে আছে–‘‘শোণরে বলি চাষার পো৷ বাঁশ বনের ধারে মান্দার রো৷’’ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘আঁধার হল মাদার গাছের তলা৷’’) গাছের তলায়৷ অনেকগুলো উবু গেঁজেল ক্রমাগত দাবী জানিয়ে আসছিল–তাদের যোগ্যতার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না৷ এর ফলে তাদের ইটালিয়ান গেঁজেল হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে৷ এতে তাদের প্রতিভাকে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে, মানবতার বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে৷ গেঁজেল–সর্দার ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু দমফাটা সিং৷ তিনি বললেন–‘‘ঠিক আছে, তাহলে আজকেই পরীক্ষাটা হয়ে যাক্৷’’
দমফাটা সিং বললেন–‘‘গাঁজার প্রথম টান দেবার সময়েই একটা ভাব নিতে হবে৷ কার ভাবটি কতখানি মঞ্চসার্থক হচ্ছে তারই ভিত্তিতে তাকে খেতাব দেওয়া হবে ও ইট দেওয়া হবে৷’’
গেঁজেলরা বললে–‘‘একটু বুঝিয়ে বলুন, আরও একটু খোলসা করে, একটু ব্যাখ্যা করে বলুন৷ তাতে আমাদের খোলতাইটা মানাবে ভাল, মৌতাতটা শানাবে ভাল৷’’
সর্দার গেঁজেল বললে–‘‘এই ধরো, কেউ গোরুর ভাব নিলে৷ তার সামনে যদি একশ’ টাকার নোট রাখা হয় সে সঙ্গে সঙ্গে নোটটা চিবোতে থাকবে, মাথা নাড়তে থাকবে, শিঙ্ দিয়ে গুঁতোতে যাবে আর হাম্বা হাম্বা আওয়াজ করতে থাকবে৷ কেউ শো’রের ভাব নিলে৷ সে সঙ্গে সঙ্গে কাছাকাছি জায়গায় যত কচুগাছ দেখবে আর মুখে আওয়াজ করতে থাকবে ‘‘ঘোঁৎ ঘোঁৎ ঘোঁৎ–রতনে রতন চেনে শো’রে চেনে কচু.......ঘোঁৎ ঘোঁৎ ঘোঁৎ৷ কেউ হয়তো ভোঁদড়ের ভাব নেবে৷ সে সামনের হাত দু’টো পায়ের মত করে ছুটতে ছুটতে জলে ঝাঁপ দেবে আর মুখে করে মাছ ধরবে৷ নাম জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘‘ভোঁ...ভোঁ...ভোঁ৷’’ গেঁজেলদের ভাষায় একে বলা হয় ভাব নেওয়া৷’’
সব যখন তৈরী, পরীক্ষারম্ভের ঘণ্ঢী যখন বাজে বাজে এমন সময় উবু–গেঁজেল ঘণ্ঢাকর্ণ ঘোড়ইয়ের পিতৃদেব লম্বাকর্ণ হঠাৎ সেখানে এসে হাজির ৷ কম বয়সে তারও গেঁজেল–জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল৷ তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সর্দার–গেঁজেল দমফাটা সিং ঘণ্ঢাকর্ণকে বললে–‘‘ওই দেখ, তোর বাপ্ আসছে৷ তুই এখন যদি মানুষ সেজে থাকিস তাহলে তোকে কথার উত্তর দিতে হবে৷ তাই তুই এখন তাড়াতাড়ি কোনো পশু–পক্ষী বা জন্তু–জানোয়ারের ভাব নিয়ে নে৷’’ ঘণ্ঢাকর্ণ সঙ্গে সঙ্গে টিয়াপাখীর ভাব নিয়ে নিলে৷ লম্বাকর্ণ এসে বললে–‘‘চল্ ঘণ্ঢাকর্ণ, বাড়ী চল্৷ সারাদিন শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর গাঁজা খাওয়া৷ এখন চাষের সময়.......ধান রোয়ার কাজ চলছে, বাড়ী চল্৷ ঘণ্ঢাকর্ণ মুখটা ছুঁচলো করে টিয়াপাখীর মত কুট কুট করে ছোলা কাটতে লাগল আর বলতে লাগল–‘‘ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ’’৷
লম্বাকর্ণ বললে–‘‘ঢঙ শিখেছে টিয়াপাখীর ভাব নিয়েছে দেখাচ্ছি মজা’’। লম্বাকর্ণ তখন মুখে করে ঘণ্ঢাকর্ণের ঘাড়টা কামড়ে ধরলে আর তারপর হুলো বেড়ালের ভাব নিয়ে বললে, ‘‘ম্যাঁও, ম্যাঁও, ম্যাঁও৷’’
ঘণ্ঢাকর্ণ তো টিয়াপাখী সেজেছে৷ বেড়াল তার ঘাড় ধরেছে৷ তাই সে আরও একবার ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ করে ঘাড়টি কাৎ করে নেতিয়ে পড়ল৷ বেড়ালরূপী লম্বাকর্ণ টিয়াপাখীরূপী ঘণ্ঢাকর্ণকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল৷
যাইহোক্ দাড়ি কামানোর কথা বলতে গিয়ে ইটালিয়ান সেলুনের কথা এসে গেল আর সেই প্রসঙ্গে এসে গেল ইটালিয়ান গেঁজেলের কথা৷ তোমরা সুযোগ পাও তো একবার দমফাটা সিংয়ের কাছে গিয়ে খোঁজ নিও৷ এই ঘটনার পরে ঘণ্ঢাকর্ণ গেঁজেল সভায় আর আসত কিনা বা এসে থাকলে সে ইটালিয়ান গেঁজেল বলে গণ্য হয়েছিল কিনা, হ্যাঁ, জেলাটা বর্ধমান না নদীয়া, সেটাও সেই সঙ্গে খোঁজ নিয়ে রেখো৷