বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
প্রকৃতি যেখানে পুরুষকে ৰন্ধনে আৰদ্ধ করে নেয় সেখানেই শুরু হয়ে যায় সৃষ্টিকার্য৷ এই ৰন্ধনীশক্তি যেখানে ঘণীভূত রূপ নেয় সেটাকে আমরা ‘স্থূল’ বলি৷ আর স্থূলতা যেখানে সর্বাল্প হয়ে যায় তাকে বলি সূক্ষ্ম আর যেখানে ৰন্ধন একেবারেই নেই তাকে বলি নির্গুণ৷ তাই মানুষের ধ্যেয় একই আর তা নির্গুণ ৰ্রহ্ম৷ ধ্যেয়কে সূক্ষ্ম হতেই হবে কেননা ধ্যেয়ের অনুরূপ মনের পরিবর্তন হয়ে যায়৷ শেষ পর্যন্ত মন ধ্যেয়ের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়৷
যেখানে ৰন্ধন নেই, তাকে আত্মা বলা হয়৷ তাই সেই–ই অধ্যাত্মবাদী যার ধ্যেয় সর্বপ্রকার ৰন্ধন মুক্ত৷ ধ্যেয় যেখানে ৰন্ধনযুক্ত আর তার পিছনে যে ছুটে চলে তাকে বলে জড়বাদী৷ জড়বাদী সর্বদা স্থূলের চিন্তা করে তথা সেইদিকে অগ্রসর হতে থাকে৷
মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজের ব্যাপ্তিকরণ চায়৷ নিজেকে বিস্তারিত করার এই আকাঙক্ষা মানুষের মধ্যে সর্বদাই বজায় থাকে৷ যে বস্তুর প্রাপ্তিতে সুখ পাওয়া যায়, তার কামনা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী থাকে৷ তাই মানুষ দিনরাত ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয়ের কাজে ব্যস্ত থাকে৷ বস্তুর তিনটি অবস্থা আছে–স্থূল, সূক্ষ্ম আর অধ্যাত্ম৷ এই তিনেরই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব আছে৷ শরীরের পূর্ত্তির জন্যে জড় তথা স্থূলের সাধনা তো করতেই হবে৷ খাদ্য গ্রহণ বিনা শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব নয়৷ মনের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে সূক্ষ্মের উপাসনা করতেই হবে৷ মানসিক বিকাশ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়৷ এর সঙ্গে আত্মার পূর্ত্তির জন্যে আধ্যাত্মিকতাও আবশ্যিক৷ এদের মধ্যে একটির বিকাশ হলে অন্যটির ক্ষুধা মেটে না৷ তাই সর্বক্ষেত্রেই পৃথক পৃথক সাধনার প্রয়োজন আছে৷
কিছু অধ্যাত্মবাদীর মত অনুযায়ী পুরুষের যে জড় বিকারপ্রাপ্ত অবস্থা বা রূপ সেই রূপের সাধনা করার কোনো প্রয়োজন নেই, বরং একমাত্র নির্গুণের উপাসনা করা উচিত৷ তাদের মতে স্থূল ও সূক্ষ্মের সাধনার কোনো প্রয়োজনই নেই কিন্তু এটা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়৷ যদি জড়ের সাধনা না করা যায় তবে খাদ্য জুটবে না৷ ফলস্বরূপ মন বিদ্রোহ করে উঠবে, আর সাধনাতেও মন একাগ্র হবেনা৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে’ যে কেবলমাত্র অধ্যাত্মবাদকে নিয়ে চলে সে আসলে সবচেয়ে বড় কপটাচারী৷ তারা অধ্যাত্মবাদের মিথ্যা প্রচার করে কেননা জঙ্গলে থাকলেও তো আহার গ্রহণের আবশ্যকতা থাকবেই৷
মানব সত্তা স্থূল, সূক্ষ্ম আর আত্মা–এই তিনের সম্বন্বয়৷ কেবল স্থূলের সাধনায় মানসিক তথা আত্মিক উন্নতি হবে না৷ মানুষ কেবল আহার পেল কিন্তু তাকে যদি পশুর মত থাকতে হয়, সে তা চাইবে না৷ কেননা শারীরিক ক্ষুধা তৃপ্ত হলেও মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষুধার নিবৃত্তির প্রয়োজন আছে৷ যার মানসিক উন্নতি হবে সে আত্মিক উন্নতিরও চেষ্টা করবে৷ জড়বাদী দেশে মানুষের অবস্থা হারেমের নারীর মত, সে সোনার আভূষণে সর্বসজ্জিত থাকলেও বাইরে বের হতে পারবে না৷ তাই এই জড়বাদীরা কপটাচারী৷
আনন্দমার্গের অধ্যাত্মবাদ অনুযায়ী স্থূল, সূক্ষ্ম ও অধ্যাত্ম– এই তিনেরই সাধনা করতে হবে৷ স্থূলের সাধনা করার সময় মানুষকে মনে রাখতে হবে যে স্থূল বস্তু পরমপুরুষের স্থূল বিকাশ মাত্র৷ ঠিক সেইরকম মানসিক ক্ষেত্রেও মানুষ স্থূল সম্পদের উপযোগ করবে, এই ক্ষেত্রে নিজের বিকাশ করতে করতেও নিজেকে সর্বদা এই দু’টি থেকে অপ্রভাবিত রাখবে৷ আর ধ্যেয় হিসেবে সর্বদা পরমপুরুষই সামনে থাকবেন৷ এইজন্যে সে গুরুমন্ত্রের প্রয়োগ করে চলবে৷ আত্মিক উন্নতির জন্যে করবে ইষ্টমন্ত্রের প্রয়োগ৷
মার্ক্সবাদের উদয় হয়েছিল শোষিত মানুষদের মধ্যে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সর্বহারা (প্রলেতারিয়েত) শ্রেণীর একাধিপত্য কায়েম করা৷ এই তত্ত্ব কেবল ভৌতিক সম্পদের বিকাশের মধ্যে সীমাৰদ্ধ ছিল৷ কিন্তু যারা মানসিক তথা আধ্যাত্মিক উন্নতি চায় তাদেরও তো বিকাশের সুযোগ দিতে হবে৷
এইভাবে আমরা দেখছি যে জড়বাদী আর পুঁজিবাদী দুই–ই অধ্যাত্মবাদের বিরোধী৷ এরা সর্বদাই মানুষের মূলনীতির পরিপন্থী৷ (প্রাতঃকালীন দর্শন, ৫ জুলাই ১৯৬০, মুজফফরপুর)