জলম্, নীরম, তোয়ম্, উদকম, কম্বলম, পানীয়াম–জলের এই ক’টি হল পর্যায়বাচক শব্দ৷ জল শব্দটিকে তৎসম রূপেই বাংলায় ব্যবহার করি৷ যার মানেany kind of water (যে কোন প্রকারের জল)৷ ‘নীর’ মানে সেই জল যা অন্যকে দেওয়া যায় ‘তোয়’ মানে যে জল উপচে পড়ে ‘উদক’ মানে যে জল খুঁড়ে পাওয়া যায় ‘কম্বল’ মানে যে জল ওপর থেকে পড়ে ‘পানীয়’ মানে যে জল পান করবার যোগ্য, খাল–বিল–নালার জল নয়৷ বাংলা ভাষায় ‘জল’ ও ‘পানী’ দুটো শব্দই চলে৷ জল শব্দটি তৎসম, আর পানী শব্দ ‘পানীয়ম’–এর তদ্ভব রূপ৷ ‘জল’ মানে যে কোন জল–ড্রেনের জল, পুকুরের জল, ফিল্টার করা কলের জল–সবই৷ তবেdrinking water বললে তার জন্যে বাংলা হবে পানীয় জল বা পানী৷ মনে রাখবে, যে কোন জলকে পানী বলবে না–পানী বলবে কেবল সেই জলকেই যা পান করবার যোগ্য৷ নালা–খাল–বিলের দূষিত জল বা কলকারখানার ময়লায় বিদূষিত নদীর জল পানী পর্যায়ভুক্ত নয়৷
কিছু লোক গঙ্গা মহিমায় একেবারেই উদ্বেল৷ এমনকি গঙ্গার মাহাত্ম বলতে গিয়ে বেসামাল হয়ে কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন যে আর সব জলই নাকি পচে যায়.... আর সব জলে নাকি পোকা হয়, কিন্তু গঙ্গাজলে তা হয় না৷ কথাটা মোটেই ঠিক নয়৷ আর সব জল যেমন, গঙ্গাজলও তেমনি৷ আজকাল অনেক নদীর জল যেভাবে বিদূষিত হচ্ছে, গঙ্গাজলও সেভাবে বিদূষিত হচ্ছে৷ কলকাতার গঙ্গা, বিশেষ করে আদি গঙ্গার জল শুধু যে পানেরই অনুপযুক্ত তাই নয়, স্নানেরও অনুপযুক্ত৷ তবে হ্যাঁ, অনেক নদীর জলই পর্বতবিধৌত৷ তাই তাতে নানা খনিজ সম্পদের মিশ্রণ থাকে৷ সেই তুলনায় সাধারণ কূপের জলের বা কলের জলের চেয়ে নদীর জলের গুণ বেশী থাকে৷ নদীর জল যদি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকে, সেক্ষেত্রে স্নানের পক্ষে[এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পানের পক্ষে] বেশ ভাল৷ দীর্ঘপথের পদযাত্রী গঙ্গা অনেক উপনদীর, অনেক খনিজ বিধৌত জলে সম্পন্না৷ তাই গঙ্গার জলে বা গঙ্গার শাখানদীর জলগুলিতে কিছু বাড়তি গুণ থাকলেও থেকে যেতে পারে৷ তবে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে গঙ্গাজল বা এই ধরনের অন্য কোন নদীর জল নিয়ে আদিখ্যেতা না করাই ভাল৷ তা না করে আন্তরিক মনোভাব নিয়ে গঙ্গাজল বিদূষণ পরিকল্পনা–শুধু কাগজে–কলমের মধ্যে না রেখে–ঠিক ভাবে রূপায়িত করতে হবে৷ তবেই দেশের ও মানুষের সত্যিকারের কল্যাণ হবে৷
বৃষ্টির তাজা জলে হাইড্রোজেন মনোক্সাইড ছাড়া অন্য কোন ধাতব বা খনিজ বস্তু নেই বললেই চলে৷ আর সে জন্যেই তা পেয় বা পানীয় হিসেবে একেবারেই অনুপযুক্ত৷ এই জল শরীরের রক্ত–সঞ্চালনে ও পরিপাক–ক্রিয়ায় তেমন কোন সাহায্য করতে পারে না৷ সেই জলই রক্ত–সঞ্চালনে ও পরিপাক–ক্রিয়ায় বেশী সাহায্য করে যা ৰন্ধু–ধাতব বা ৰন্ধু–খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ৷ বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় মুখ্যতঃ ও গৌণতঃ পশ্চিম রাঢ়ের সর্বত্র কূপের জল, নদীর বালির নিম্নস্থ জল (চুঁইয়ে) খনিজ সমৃদ্ধ থাকায় তা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ভাল৷ খনিজ সম্পদ থাকায় ওই জলের স্বাদও ভাল৷ ভাল জলের বর্ণনায় কখনো কখনো বলা হয়, যে জল বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন, তাই–ই ভাল জল৷ কিন্তু কথাটা ঠিক নয়৷ যে জলে খনিজ সম্পদ আছে তাতে একটু বর্ণ তো আসতেই পারে, স্বাদ তো আসবেই, ক্কচিৎ কখনো কোন খনিজ গন্ধও থাকতে পারে৷
আসলে ভাল জল বলতে তাকেই বুঝি যা রোগবীজাণু–মুক্ত ও তাতে নেগেটিব মাইক্রোবাইটা না থাকার সামিল৷ বাঁকুড়া জেলার খাতড়ার দুধে ঝর্ণার জল একটু শাদাটে ও ওই জল খনিজ সম্পদে পূর্ণ৷ রাঢ় বাংলার এটি একটি খুব ভাল মানের জল৷ পুরুলিয়া জেলার ঝালদা–জয়পুর–আরশ্ থানার জলের গুণের তুলনা নেই৷ কিন্তু তারা নিজেরা বর্ণহীন–স্বাদহীন– নয়৷ বীরভূমের পশ্চিমাংশ থেকে দক্ষিণ–পূর্বে নান্নুর থানা পর্যন্ত ভূগর্ভের শিলাস্তরে সঞ্চিত গন্ধক রয়েছে, তার ফলে ওই অঞ্চলের জলের মান খুবই ভাল৷ কূপ থেকে কোথাও কোথাও তপ্ত জল বেরিয়ে আসে৷ জলে কথঞ্চিৎ গন্ধকের গন্ধও আছে৷ অথচ ওই জল পানীয় হিসেবে ভাল ও চর্মরোগের প্রতিষেধক৷ তা সেই যাই হোক, এই যে বৃষ্টির জল যা অনেক ভাল ভাল কাজে (যেমন চাষবাস ইত্যাদি) ও ঔষধার্থে ব্যবহূত হয় তা কিন্তু আদৌ পানের উপযুক্ত নয়৷ বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদীর জল বা জলাধারে সঞ্চিত বৃষ্টির জলে যেহেতু খনিজ সম্পদ মিশ্রিত হবার সুযোগ পায়, তাই সে সব ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়৷
মধুকোরক, ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭, কলিকাতা
যে সকল জলে ধাতব বা খনিজ বস্তু আছে তাকে বকযন্ত্রে(distilling retort) চোলাই করলে(distillation) আমরা যে ডিস্টিল্ড্ ওয়াটার পাই তাও ঔষধ রূপে উত্তম ভাবে ব্যবহার করা যাবে ও তা যায়ও৷ তবে পেয় হিসেবে এ জল একেবারে অনুপযুক্ত..... বৃষ্টির জলের চেয়েও অনুপযুক্ত৷
জল সম্পদ সংরক্ষণে
নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীর অনেক অংশেই তীব্র জল–সংকট দেখা দেবে৷ পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মরুভূমি তৈরী হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে৷ ভূগর্ভস্থ জল নীচে নেবে যাওয়ার অর্থই হ’ল ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি মাটি শুকিয়ে যাওয়া, যার ফলে গাছপালাও শুকিয়ে মরে যায়৷ রাজস্থানের অনেক অংশে ঠিক এই রকমটাই হয়েছে৷ মানুষ অতীতে জলের আকাল আর খরার কবলে পড়ে অনেক ভুগেছে আর ভবিষ্যতে যদি ওই ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আরো ভুগবে৷ যদি ভূগর্ভস্থ জলকে নিয়ে যথেচ্ছাচার চলতে থাকে তাহলে পৃথিবীর অনেক দেশ ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ভয়ংকর জল সঙ্কটের মধ্যে পড়বে৷ এই মর্মান্তিক পরিণতি থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হ’ল অবিলম্বে জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্যে একটি বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা রূপায়িত করা৷
একটা সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হবে যে ভূগর্ভস্থ জলের তুলনায় ভূপৃষ্ঠের জলের ব্যবহারকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া৷ লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে ভূ–পৃষ্ঠস্থ জলের বর্ত্তমান পরিমাণকে অবিলম্বে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা যায়৷ তবে সবচেয়ে ভাল হবে যদি দশগুণ বাড়ানো যায়৷ বৃষ্টির জলধারা সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে৷[বৃষ্টির জলধারার প্রধান অংশটাই নদীবাহিত হয়ে সমুদ্রে পড়ে নষ্ট হয]৷ প্রথম পদক্ষেপ হবে সেই সব পুকুর, বিল, বাঁধ, সায়র, নদী আর ৰড় জলাধার–যা বর্ত্তমানে জলসঞ্চয়ের জন্যে ব্যবহূত হচ্ছে তার গভীরতা বাড়িয়ে দেওয়া৷ দ্বিতীয় পদক্ষেপ হ’ল এই স্টোরেজের (জলভাণ্ডার) সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকা বাড়িয়ে দেওয়া৷ (এর সঙ্গে দেশ জুড়ে) অনেক ছোট ছোট পুকুর, বাঁধ(check dams), বিল, সায়র ও জলাধার তৈরী করতে হবে৷ তৃতীয় পদক্ষেপ হ’ল (নদী, জোড়, পুকুর, বাধ–এদের) চারিপাশে ও অন্যান্য জায়গায় গাছের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে চলা৷ তাই জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল ব্যাপক ভাবে বন–সর্জন করা৷ (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’২ থেকে)