আক্ল্মন্দ্ সিং সেবার কাঁথি গেছল৷ জুনপুট থেকে দীঘা পর্যন্ত সমুদ্র–উপকূল ধরে খুক্ষ ক্ষেড়াত৷ খুক্ষ কাজুক্ষাদাম আর ক্ষাদাম–সন্দেশ খেত, দিনকাল ভালই কাটছিল৷ এমন সময় একবার তার কী যে খেয়াল হ’ল, দুপুর বারটার শো–তে সিনেমা দেখতে গেল৷ ছবিটি নাচ–গান–হৈ–হল্লায় ভর্ত্তি৷ গল্পটা মুখ্যতঃ ট্র্যাজেডি৷ ওই ধরনের ছবিতে যেমনটি হয় এক্ষেত্রেও ব্যাপার–স্যাপার তেমনটিই৷ নায়ক–নায়িকা দু’জনেই সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করলে৷ দু’টো চিতায় তাদের জ্বালানোও হ’ল৷ তার পরের ছবিতে দেখানো হ’ল তারা দু’জনেই যথাকালে নরকে গিয়ে পৌঁছোল৷ যমরাজের উপস্থিতিতে তাদের মালাক্ষদল করে বিয়েও হয়ে গেল৷ মেয়েরা হুলুধ্বনি দিলেন৷ পুরুত তার পাওনা ক্ষুঝে নিয়ে চলে গেল৷ অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজেডিকে কমেডিতে রূপান্তরিত করা হ’ল৷ আক্ল্মন্দ্ সিংয়ের ছক্ষিটা খুক্ষ পছন্দ হ’ল৷ সে তিনটের শো’য়েও ওই ছবিটাই দেখলে৷ এবার আরও ভাল লাগল৷ ছ’টার শোয়েও ওই ছবিটাই দেখলে৷ এবার আরও ভাল লাগল৷ এবার সে নাইট শো–তেও ওই ছবিটাই দেখলে৷ এবার আরও ভাল লাগল৷ কিন্তু রাত্রি বারটার পরে আর কোন শো ছিল না৷ তাই ভারাক্রান্ত মনে তাকে হোটেল–মুখো হতে হ’ল৷
আক্ল্মন্দ্ সিং হোটেলের দিকে চলেছে৷ দক্ষিণে সমুদ্র৷ আরে ঝাউ ক্ষনের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে ওটা কী চাঁদ, না সূর্য? ঘড়িতে ক্ষেজেছে একটা.....এটা দুপুর একটা, না রাত একটা আক্ল্মন্দ্ সিংয়ের মনে দু’টো প্রশ্ণ নড়াচড়া করতে লাগল৷ প্রশ্ণ দু’টো রীতিমত ডন–বৈঠক মারতে লাগল৷ প্রথম প্রশ্ণ হ’ল–আকাশে প্রকাণ্ড ক্ষড় ওটা কী? আর দ্বিতীয় প্রশ্ণ–এখন রাত একটা, না দিন একটা? যদি আকাশে ওটা চাঁদ হয়, তাহলে অত বড় চাঁদ কেন হবে? আর তা সামনা–সামনি না এসে ঝাউক্ষনের ফাঁক দিয়েই বা কেন তাকাক্ষে? আর ওটা যদি সূর্য হয় তা হলে সূর্যের তাপে গনগনে গরম কেন হবে না আর এখন যদি রাত একটা হয় তাহলে নিশ্চয় ওটা চাঁদ, আর এখন যদি দুপুর একটা হয় তাহলে ওটা নিশ্চয় সূর্য৷
আক্ল্মন্দ্ সিং আকাশ–পাতাল ভেবে চলেছে.......আর আক্কেল–দাঁতে* দাঁত ঘসে চলেছে৷
এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়াল একটা ট্রাক৷ সে ভাবলে–ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করা যাক এখন রাত একটা না দিন একটা, আর আকাশে ওটা চাঁদ না সূর্য৷
ড্রাইভার ওকে দেখেই লাফিয়ে গাড়ী থেকে নেক্ষে পড়ল৷ আক্ল্মন্দ্ সিং সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলে –আরে ও যে ওরই ছোটবেলাকার সাথী ক্ষেয়াক্কিলে সিং৷ ওই ক্ষেয়াক্কিলে সিং আর তার ক্ষোন ক্ষিচ্ছুরাণী দেবীর সঙ্গে সে পাঠশালায় এক সঙ্গে পড়েছিল৷
দু’জনেই তখন আহ্লাদে আটখানা৷ কতদিন পরে দেখা হ’ল ক্ষেয়াক্কিলে সিং জিজ্ঞেস করলে–‘‘হ্যাঁরে আক্ল্মন্দ্, আজকাল করছিস কী?’’
আক্ল্মন্দ্ বললে–‘‘আপাততঃ মন্ত্রীর কাজ করে চলেছি৷ তুই, করছিস কী?’’
ক্ষেয়াক্কিলে সিং বললে–‘‘আমি আজকাল টরাক চালাই৷’’
আক্ল্মন্দ্ তখন আসল কথাটা পাড়লে৷ সে বললে–‘‘আচ্ছা ক্ষলতো, এখন দিন একটা না রাত একটা? আর আকাশে ওটা কী–চাঁদ না সূর্য?’’
ক্ষেয়াক্কিলে সিং বললে–‘‘এদেশে তুইও বিদেশী, আমিও বিদেশী৷ কি করে ক্ষলব ওটা এদেশের চাঁদ না সূর্য আর কী করেই বা ক্ষলব রাত একটায় এদেশে দিন না রাত আর দুপুর একটায় এদেশের রাত না দিন তাই আমরা যেমন ইচ্ছে ভেবে যেতে পারি৷ কারও কাছে কোন কৈফিয়ৎ দিতে হবে না’’৷
আক্ল্মন্দ্ সিং বললে–‘‘ঠিকই বলেছিস৷’’
* * * *
তারপর থেকে রোজই সন্ধেয় আক্লমন্দ্ সিংয়ের সঙ্গে ক্ষেয়াক্কিলে সিংয়ের দেখাসাক্ষাৎ গল্পগুজব চলতে থাকল৷ আক্ল্মন্দ্ সিংয়ের পথঘাট তেমন জানা ছিল না৷ ক্ষেয়াক্কিলে সিং ট্রাক–ড্রাইভার৷ তাই সে পথঘাট জানত৷ ট্রাক নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া চলে না৷ তাই সন্ধেয় সে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসত মোটর সাইকেলে চড়ে৷
একদিন সে মোটর সাইকেলে চড়ে আসছে.......দীঘা সৈকতে তখন একটু জোরালো হাওয়া বইছে৷ তার ক্ষুকের দিকের ক্ষোতামগুলোর ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হু হু করে৷ তারপর জামার ভেতরে ঢুকে সেই হাওয়া পিঠের দিকের জামাকে চাপ দিচ্ছে৷ তার ফলে পিঠের দিকের জামাটা ফুলে উঠছে৷
ক্ষেয়াক্কিলে সিং ভাবলে–আচ্ছা ফ্যাসাদ তো এটা এমন একটা ক্ষড় মানবিক সমস্যা, অথচ আজ পর্যন্ত কোন জ্ঞানী–গুণী মানুষই এর সমাধান করেননি৷ সে ভাবলে যদিও আমি নামে ক্ষেয়াক্কিলে কিন্তু কাজেতে যে ক্ষেয়াক্কিলে নই সেটা আজই প্রমাণ করে দোক্ষ৷ সে জামাটা উল্টো করে পরে নিলে৷ জামার ক্ষোতামের ঘরগুলো রইল পিঠের দিকে আর জামার পিছন দিকটা রইল তার বুকের দিকে৷ এবার মহা আরাম ক্ষুকের দিকে ক্ষোতামের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকতে পারছে না৷ আর যদিও বা অল্প–স্বল্প হাওয়া ঢুকছে, পেছনের দিকের জামা আর হাওয়ায় ফুলতে পারছে না৷ একটু অসুবিধে হচ্ছিল কেবল বুক–পকেটে রাখা ফাউন্টেন পেনটাকে নিয়ে কারণ ওটা তখন পিঠের দিকে রয়ে গেছে কিনা
ক্ষেয়াক্কিলে নির্ভাবনায় মোটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে,......যাচ্ছে.....যাচ্ছে.....যাচ্ছে৷ সামনের দিক থেকে হঠাৎ দেখা গেল–আসছে একটা প্রকাণ্ড ট্রাক৷ তখন সন্ধে হয়ে গেছে, তার দু’পাশের আলোগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে৷ ক্ষেয়াক্কিলে সিং তাই দেখে ভাবলে–তারই মত দু’জন মোটর সাইকেল–আরোহী পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে সামনের দিকে আসছে৷ সে ভাবলে–দু’টো মোটর সাইকেল যখন যথাযথ সমতা রক্ষা করে পাশাপাশি আসছে তখন আমি ঠিক ওদের মাঝখানটা দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে যাই৷
যা ভাবা তা–ই করা৷ সে দু’টো বাতির ঠিক মাঝখানটিতে নজর রেখে নিজের গাড়ী চালিয়ে দিলে৷
ট্রাক–ড্রাইভার দেখলে, জেনেক্ষুঝে দেখেশুণে একটা মোটর সাইকেল সবেগে তার ট্রাকের দিকে ছুটে আসছে৷ সে তখন ষোল আনা ঝুঁকি নিয়ে সশব্দে তার ট্রাক থামিয়ে দিলে৷ কিন্তু ক্ষেয়াক্কিলে সিং তার মোটর সাইকেল থামাল না৷ মোটর সাইকেল এসে ধাক্কা দিল ট্রাকে৷ গাড়ীসহ ক্ষেয়াক্কিলে সিং ছিটকে পড়ল৷ মোটর সাইকেলটা ভেঙ্গে তুক্ষড়ে গেল৷ ক্ষেয়াক্কিলে সিং অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল৷ পুলিশী হুজ্জোৎ আর জনতার ঘেরাওয়ের ভয়ে ট্রাক ড্রাইভার চম্পট দিল৷
আক্ল্মন্দ্ সিং অনেকক্ষণ ধরেই ক্ষেয়াক্কিলে সিং–এর আসা পথ চেয়ে ক্ষসে আছে ৷ কিন্তু ক্ষেয়াক্কিলে সিং আসছে না......আসে না.....আসে না.....আসেই না৷ খানিক পর আক্ল্মন্দ্ সিং ক্ষেয়াক্কিলে সিং যে রাস্তা দিয়ে আসে সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল–কোন দুর্ঘটনা হয়েছে কিনা তা–ই দেখতে৷ সে যা ভেবেছিল তাই ঘটেছে৷ তোক্ষড়ানো দোমড়ানো মোটর সাইকেলটা এক পাশে পড়ে রয়েছে আর তারই কিছু দূরে মুখ থুক্ষড়ে পড়ে রয়েছে ক্ষেয়াক্কিলে সিং৷ আক্ল্মন্দ্ সিং দেখলে, আঘাত গুরুতর হলেও প্রাণঘাতক নয়৷ তবে সব কিছুই পরীক্ষা করার পরে সে সবিস্ময়ে দেখলে ক্ষেয়াক্কিলে সিংয়ের মুণ্ডুটা একেবারে ঘুরে গেছে অর্থাৎ ক্ষোতামের ঘরগুলো যেদিকে মানুষের মুখ তো সেদিকে থাকে, কিন্তু ক্ষেয়াক্কিলে সিংয়ের মাথাটা এমন ঘুরে গেছে যে ঘুরে তার ঘাড়টা ক্ষোতামের ঘরের দিকে এসে গেছে৷ কাছে পিঠে কোথাও ডাক্তার আছে কি না কে জানে ফার্ষ্ট এডের (প্রাথমিক চিকিৎসা ) ব্যবস্থা সে নিজেই করতে বসল৷ ক্ষেয়াক্কিলে সিংয়ের মুণ্ডুটা ঘুরিয়ে ক্ষোতামের ঘরগুলো যেদিকে সেদিকে করে দেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে লাগল৷ একে দারুণ আঘাতে ক্ষেয়াক্কিলে সিং হত চৈতন্য, তারপর এই মুণ্ডু ঘোরানোর কসরৎ–এ দু’য়ের মণি–কাঞ্চন সংযোগে ক্ষেয়াক্কিলে সিংয়ের কী দশা হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়৷
গল্প শেষ হ’ল৷ আক্ল্মন্দ্ সিং নামটা কেমন ছিল তা পাঠকেরাই বিচার করুন৷