কী খাব? কোন্ পথে যাব?

লেখক
অাচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

সম্প্রতি ভোজন রসিকদের মধ্যে হাহাকার শোণা যাচ্ছে৷ সবার মুখে প্রশ্ণ, ‘কী খাব?’ রা ভোজন রসিক, বিশেষ করে কলকাতার তথাকথিত অভিজাত বা পয়সাওয়ালা শ্রেণীর মানুষ যাঁরা প্রায় নিয়মিত নিউমার্কেটের বড় বড় হোটেল, রেস্তোঁরায় বা অন্যান্য নামী-দামী হোটেল রেস্তোঁরায় জমিয়ে মাংসের আইটেম খেতেন, তাঁদের চোখে-মুখে এখন আতঙ্ক৷ এতদিন আমরা ভাগারের মৃত পশুর মাংস বা পচা মুরগীর মাংস জমিয়ে খেতুম৷ এখন তো মাংসের প্রতি ঘেন্না ধরে যাচ্ছে৷ বলা বাহুল্য, বড়-ছোট সব হোটেল, রেস্তোঁরায় এতদিন ভাগারের এই পচা মাংস বা রাজাবাজারের হিমঘর থেকে পচা মুরগীর মাংসের সঙ্গে নানান কেমিকেল মিশিয়ে সুস্বাদু করে সরবরাহ করা হ’ত৷ স্বাভাবিকভাবে এইসব মাংষ ডেকে আনত নানান কাল ব্যাধি৷ কিন্তু এই সব কাল ব্যাধি যে মাংস থেকে আসত, তা তো আর বোঝা যায়নি! কিন্তু এখন যত ভাগাড় কাণ্ডের তদন্ত এগোচ্ছে ততই মাংস প্রেমীর মানুষের মনে আতঙ্ক ঘনীভূত হচ্ছে৷ সবার মনে এই চিন্তা---‘কী খাব?’

অবশ্য তলিয়ে দেখতে গেলে, প্লাস্টিক ডিম কেমিকেল মিশিয়ে কৃত্রিম দুধ, বা ভালো প্যাকেট দুধ থেকে পাঁচ লিটার দুধকে কুড়ি লিটার করার বাজারি ‘ম্যাজিক’---এ সবও মানুষের মনে আগে থেকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আছে৷ কম-বেশী সব খাদ্যের ক্ষেত্রেও এখন মানুষের আতঙ্ক৷ মানুষকে যে আজ বিশ্বাস করা যাচ্ছে না৷ মানুষ অনৈতিকতার অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে৷ সমাজের সব ক্ষেত্রেই এই দুর্নীতি৷ এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

মানুষ গৌন, মুখ্য হচ্ছে টাকা৷ দুনিয়ার টাকার বশ৷ এই পুঁজিবাদী মুল্যবোধের জন্ম কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাতেই৷ পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, জড়বাদ---সবই একই বৃন্তের ফসল৷ মানব মনস্তত্ত্বের গোড়ার কথা হ’ল, মানুষের মনের অসীম চাহিদা৷ ‘আমি যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই যাহা পাই তাহা চাই না৷’ মানুষের মনের অনন্ত চাহিদা আর এই অনন্ত চাহিদা নিয়ে ছুটে চলেছে সীমিত স্থূল ভোগ্যবস্তুর দিকে৷ যেন, দশ জন ক্ষুধার্ত মানুষ প্রত্যেকেই দশটা বা তারও বেশী রুটি চায়৷ কিন্তু আছে মাত্র দশখানা রুটি৷ এখন সবাই যদি যত ইচ্ছা রুটি চায় তাহলে লড়াই তো লাগবেই৷

 

সবাই যদি তাদের মনের অনন্ত চাহিদা নিয়ে সীমিত ভোগ্যপণ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি তাহলে এ নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধবেই৷ এই আরও স্থূল ভোগ্য সম্পদ কুক্ষিগত করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই তাকে দুর্নীতি ও শোষণের পথে ঠেলে দেয়৷ মানুষকে অমানুষ করে দেয়৷

এইটাই তো আজ হচ্ছে৷ ভাগাড় কাণ্ড থেকে শুরু করে সমাজের বড় বড় দুর্নীতি, তা সে নীরব মোদীর মত ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারী হোক বা বিভিন্ন তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের ‘পুকুর চুরি’ হোক---সবই কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা৷ একই সুরে বাঁধা৷ সবার মূলীভূত কারণ একটাই৷ লোভ আর লোভ৷

এর সমাধান ভোগবাদী, পুঁজিবাদী, জড়বাদী সমাজে নেই---তাদের দর্শনেই নেই৷ এখানেই যুগান্তকারী ‘প্রাউট দর্শন’-এর বিশেষত্ব৷ মানুষের এই অনন্ত চাহিদাকে কেবল স্থূল ভোগ্য সম্পদের পানে ছুটিয়ে না দিয়ে সূক্ষ্ম মানসিক ও আত্মিক সম্পদের পেছনে ছোটাতে হবে৷

প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘আজকের সমস্যা’ পুস্তকে বলেছেন মানুষের ক্ষুধা অনন্ত, এই অনন্ত ক্ষুধাকে সে যদি জাগতিক ভোগ্যবস্তুর দিকে ছুটিয়ে দেয় তাহলে মানুষে মানুষে সংঘর্ষ বাঁধবেই কারণ জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ একজনের প্রাচুর্য ঘটলে অন্যের অভাব দেখা দেয়৷ মানুষের এই ক্ষুধা মানস তথা আধ্যাত্ম সম্পদেই মেটাতে হবে৷ ব্রহ্ম অকৃপণভাবে অনন্ত মানস তথাআধ্যাত্ম সম্পদ মানুষের সামনে সাজিয়ে রেখেছেন৷ মানুষকে সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে হবে৷

বলতে গেলে মানুষের মনের একটা ক্ষুধার্ত বাঘ রয়েছে, আর সেই ক্ষুধার্ত বাঘ সব-সময়ই বলছে---‘ম্যাঁয় ভুখা হুঁ৷’ আর এরই ফলে যত অশান্তি যত দুর্নীতি, যত বিশৃঙ্খলা৷

তাই প্রাউটের গোড়ার কথা হ’ল, মানুষের তিন ধরণের ক্ষুধা৷ জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ মনের ক্ষুধাকে কেবলমাত্র স্থূল সম্পদের দিকে না চালিয়ে মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের দিকে চ্যানেলাইজ করতেই হবে৷  যথার্থ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার এটাই সুদৃঢ় ভিত্তি৷ জড়বাদী নৈতিকতা একটা অপবিত্র চুক্তি---একটা ভঙ্গুর কাচের পাত্র৷ তার স্থায়িত্ব নেই৷ আর তথাকথিত ‘রিলিজিয়াস’ বা ‘সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের শিক্ষা’ও কিছু ডগ্মা বা ভাবজড়তার সমষ্টি মাত্র৷ এই সব সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্টও মানব সমাজের পক্ষে কখনোই কল্যাণকর নয়৷ উদার আধ্যাত্মিকতা যা সমস্ত মানুষের জন্যে এক ও সমান৷, যা প্রকৃতপক্ষে যুক্তিবিজ্ঞানসম্মতভ্ মানুষের মনের ক্রমবিস্তারের কথা বলে, সেই আধ্যাত্মিকতাভিত্তিক সামাজিক দৃষ্টিকোণই একমাত্র ৩৬০০ দৃষ্টিকোণ---যা বিশ্বের সমস্ত মানুষ তথা সমস্ত সত্ত্বার কল্যাণের ভাবনায় অভিষিক্ত৷ এরই নাম নব্যমানবতাবাদ৷

আজ তাই লোভ লালসা বা লাভের (মুনাফা) ওপর আধারিত অন্ধ দিশাহীন, জড়বাদী আধুনিকতা নয়৷ যথার্থ নব্যমানবতাবাদী ভাবধারার ব্যাপক প্রসার, অনুশীলন ও বাস্তবায়নের মধ্যেই আছে আজকের সমাজের সর্বপ্রকারড় সমসার সমাধানের চাবিকাঠি৷