কল্যাণ চেতনার হীরে মাণিক

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

বাঙলা তথা ভারতবর্ষের জীবনধর্ম বা জীবনাদর্শ অনুযায়ী ব্যষ্টি মানুষের যথাযথ চলন বা আদর্শ জীবন ছন্দ হচ্ছে---‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’৷ অর্থাৎ জগতের কল্যাণের সঙ্গে ব্যষ্টি জীবনের পূর্ণতা লাভ৷ ব্যষ্টি মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল ও বিকাশের সঙ্গে সমাজের কল্যাণ ও প্রগতির  মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা৷ এটা কেবল বাঙলা বা ভারতবর্ষের আদর্শ জীবনছন্দ ভাবলে ভুল হবে৷ এটা জীব হিসেবে মানুষ প্রজাতির (স্পেসিস্‌) আদর্শ জীবনধারা৷ আসলে মানুষের এগিয়ে চলার ধরণ বা গতিটা হচ্ছে ভৌত-মানসিক ও মানস আধ্যাত্মিক৷ একেই এক কথায় বলে ‘প্রগতি’৷ মানুষের জীবনচর্যায় এই প্রগতিই তো কাম্য৷ কেউ শিক্ষা-দীক্ষায় অর্থনৈতিক স্বম্ভরতায় তথা সব দিক থেকে এগিয়ে থেকে প্রগতি করবে, আর সমাজের অন্যান্য মানুষেরা বঞ্চনায়-অবজ্ঞায়-অবহেলায় পিছনে পড়ে থাকবে, আর্তনাদ করবে-তাহলে তো আর সমাজের প্রগতি হোলনা৷ মুষ্টিমেয় বা দু-একজনের প্রগতি হলে কি তাকে সমাজের  ‘প্রগতি হয়েছে’ বলা যায়! যায় না৷ তাই ব্যষ্টির সর্র্বেচ্চ কল্যাণের (ব্যষ্টি কল্যাণ যেখানে যে পর্যন্ত সমষ্টির কল্যাণের পথে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় না) একটা পাথেয় হচ্ছে সমাজের কল্যাণ, অর্থাৎ জনসেবা৷ কেবল নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে যেখানে সামূহিক কল্যাণ হচ্ছে সেখানে আত্ম নিয়োগ করা৷ প্রয়োজনে নিজের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে সমাজের সামূহিক কল্যাণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা৷ সমাজের সকলের কল্যাণ হলে তো সংশ্লিষ্টের  বা ব্যষ্টি বিশেষেরও কল্যাণ হবে৷ এই যে নিজের স্বার্থের দিকে না দেখে সমাজের স্বার্থের দিকে দেখা--- একে এক কথায় বলে ‘তপঃ’৷ যেখানে সামূহিক কল্যাণ হচ্ছে, সেখানে  ব্যষ্টিগত কল্যাণ হোক আর নাই হোক তাকে বলে ‘তপ’--- দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷’’ কার্যতঃ ---ব্যাপারটা দাঁড়াল সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষে সমাজসেবা বা জনসেবা বিনে কোন মানুষের জীবন পূর্ণতা পায় না, মানুস মোক্ষ-মুক্তি পেতে গেলে সমাজের কল্যাণ বা জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা না করতে পারলে শেষ অবধি তা কখনই সম্ভব হয় না৷ কেউ ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে, নাক টিপে প্রাণায়াম করবে, ঈশ্বরের ধ্যান করবে সংসার ছেড়ে সুখ দুঃখের বাস্তব জগত থেকে পালিয়ে গিয়ে বন-জঙ্গলে গিরি-গুহায় ভগবানের ভজনা করবে, আর মানুষ নাখেয়ে মরবে, রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করবে, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে না তাদের দিকে ঘুরেও তাকাবে না, --- ওমনি ঈশ্বর এসে দরজায় কড়া নাড়বে--- তা কী কখনও হয়! হয় না৷ যুক্তির খাতিরে জড়-অজড়, অণু-পরমাণু-ত্রসরেণু সব কিছুতে যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন তবে ওই আর্ত-পীড়িত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষগুলোর মধ্যেও অবশ্যই ঈশ্বর বিরাজ করেন৷ এই খণ্ড-ঈশ্বর বিষয়ে নির্বিকার থেকে, অবহেলা-অবজ্ঞা অসম্মান করে পূর্ণ হওয়া যায়না শত কেন, হাজার বছর ধরে সাধনা করলেও সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়না, প্রাণের ঠাকুরও ধরা দেননা৷ তাছাড়া মোক্ষ-মুক্তি, পূর্ণতা প্রাপ্তি, ভগবানকে পাওয়া, ধ্যান বা ঈশ্বর সাধনা যাই বলা হোক না কেন সহজ সত্যটা হচ্ছে ১) মনের বিস্তৃতি ঘটানো৷ অর্থাৎ মনের পরিধিকে বাড়াতে বাড়াতে অনন্তে সমাহিত করা৷ ভাবের ঘরাণায় জীব বা মানুষের যে অনন্ত শক্তি থেকে উৎসারণ ঘটেছে--- সেই উৎস মূলে ফিরে যাওয়া৷ ২) এই উদ্দেশ্যে সাধনাবিজ্ঞান বা ‘স্পিরিচ্যুয়াল কাল্ট্‌’---‘আধ্যাত্মিক নিত্যপ্রয়াস’ অবশ্যই আছে, তবে আধ্যাত্মবিজ্ঞানে এটা মানুষের অন্তর্র্লেকের প্রয়াস, আর বহিরঙ্গে বা বৈবহারিক জীবনে প্রয়াস বা দিশাটা হচ্ছে একান্তভাবেই---সেবাধর্ম,---অর্থাৎ ‘জীবের সেবা’ বা জনসেবা৷ সেবা ছাড়া সাধনা বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ৷ অর্থাৎ সাধনামার্গে ‘আধ্যাত্মিক নিত্যপ্রয়াস’ ও জনসেবা একই মুদ্রার যুগনদ্ধ এপিঠ ও ওপিঠের মতন৷ এই সহজ সত্যটাই ধরা পড়েছে স্বামী বিবেকানন্দজীর একটা ছন্দবদ্ধ বাণীতে--- ‘‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর৷’’ (ক্রমশ)