পূর্ব প্রকাশিতের পর,
এখন প্রশ্ণ হচ্ছে এই যে জীবসেবা বা জনসেবা বা সমাজসেবা --ব্যাপারটার পিছনে যুক্তিবিজ্ঞান বা কার্যকারণ সম্পর্কটা কোথায় ? যেমন ---১. মানুষ যেসময় জনসেবা করে বা সঠিক ভাবে ’’তপঃ’’ করে সেই সময় তার মনে জনসেবা ছাড়া অন্য কোন ভাবনা আসেনা৷ জনহিতৈষী ’জন’’’’কে অর্থাৎ মানুষ কে সাক্ষাৎ ঈশ্বর বা নারায়ণ জ্ঞানেই সেবা করে ৷ অনুমনের সঙ্গে ভূমামনের একটা যোগসূত্র তৈরী হয়ে যায়৷ দাতার সঙ্গে গ্রহীতার একাত্মতাবোধ ,সহমর্মিতার উদ্গম হয়৷ বলাবাহুল্য, জনসেবা কালে এই ভাবটুকু যদি না থাকে , তবে তা নেহাতই কিছু পাওয়ার লোভে ব্যবসাদারী বিনিয়োগের মত--- যা এখনকার রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন --- নির্বাচন এলে বোটব্যাঙ্ক যাতে অটুট থাকে৷ অর্থাৎ জনহিতের আছিলায় বোট কুড়ানো৷ তাই বলা হয়--আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রকৃত সমাজসেবা করা যায় না৷ জনসেবা থেকে ’জন’এর নারায়ণী রূপ্ঢা বাদ দিলে ‘সেবা’র নাম ভনিতা ,ধান্দা , ফিকির, বিনিয়োগ বা ব্যবসা৷
২. আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য একটা নির্মল মন দরকার৷ এই নির্মল মনটা কেমন না যে মনে কোন হীনমন্যতা-মহামন্যতা ,জাতপাতের-ধনীদরিদ্রের ভেদবুদ্ধি , উচু-নীচু ছোট-বড়’’র সংকীর্ণতা, কোন দম্ভ-অহংকার থাকবে না৷’ এইজন্যে বলা হয়, আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে, আর মনকে নির্মল রাখার জন্য জনসেবা এক আবশ্যক সাধনাঙ্গ ’৷
৩. আধ্যাত্মিক জগতে একটা দৃঢ় বিশ্বাস যে যতই সাধনা-ধ্যান করোনা কেন গুরুর বা পরমপুরুষের কৃপা ছাড়া আধ্যাত্মিক উন্নতি বা মোক্ষ-মুক্তি কিছুই হবেনা৷ সমাজে একটা প্রবচনের চল আছে--’’ মায়ের সন্তানকে ভালবাসতে পারলে মায়ের স্নেহ-ভালবাসা-সহানুভূতি সব পাওয়া যায়৷’’সেই রকম স্রষ্টার কোন সৃষ্টিকে অস্বীকার করে , ঘৃণা-অবজ্ঞা করে, ছোট-নীচ বলে পিছনে-পিছিয়ে ফেলে রেখে স্রষ্টার অর্থাৎ পরমপুরুষের কৃপা ধন্য হওয়া যায় না ৷ স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই চির বিরাজমান৷ তাই সৃষ্টির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ভাবনা , অর্থাৎ জনসেবার ভাবনা-ই সাধনাতে সাহায্য করে , পরমাত্মার কৃপা বর্ষণ হয়৷
৪. ভৌতিক বা পার্থিব জীবনে মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়াটা হচ্ছে মহত্বের গৌরবের শিরোরত্ন৷ ’’মহান’’ হওয়ার সহজ ও একমাত্র পথটি হল ’’সাধনা-সেবা-ত্যাগের মার্গ অনুসরন করা ৷ জনমান্যে জনসেবা হচ্ছে সেই মহান হয়ার মন্ত্রগুপ্তি ( যদিও মহান হয়াটাই কারো লক্ষ্য হতে পারে না ,---মানুষের চরম লক্ষ্য ---পূর্ণতালাভ তথা ব্রহ্মসম্প্রাপ্তি)৷
৫.সমাজে কিছুমানুষ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে অবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণী-বিকৃত ভাবনা পোষিত ভ্রান্তিবশতঃ অথবা ব্যষ্টি বা গোষ্ঠী স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে জ্ঞাতসারে বিভেদের জাল বুনে চলে, ভাবে ও প্রচার করে--- এতেই সমাজের কল্যাণ ৷ এতে কিছু মানুষের কিছু সময়ের জন্যে গোষ্টি বা ব্যষ্টি স্বার্থ হয়তো সিদ্ধ হতেও পারে , তথাপি তা কখনই স্থায়ীভাবে ও সার্বিকভাবে মানুষের কল্যাণ করতে পারেনা৷ কিন্তু, বলাবাহুল্য, উৎপত্তির উৎস ও স্বরূপ বিচারে, জীবপ্রজাতিগতধর্ম বিচারে মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ তাই এই অখণ্ড মানব সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যে একান্ত ভাবেই দরকার সংশ্লেষণের পথ৷ মানে- সার্বভৌমিক আদর্শের মাধ্যমে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা৷ অর্থাৎ সহজ কথায় অনেককে এক করার মধ্যেই রয়েছে সংশ্লেষণের আসল পরিচয়৷ বস্তুতঃ , সেবা ও কল্যাণের মধ্যেই আছে এই সংশ্লেষণের বীজ৷ সর্বজনের হিতের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মমুখী মানসিকতা চালিত-তাড়িত সমাজসেবা বা জনসেবাতেই মানুষের সত্যিকারের কল্যাণ৷ তাই সমাজসেবা একাধারে যেমন ভৌত-মানসিক , তেমনি মানস-আধ্যাত্মিক৷ ’ তাই একটা সুন্দর ও অখণ্ড সমাজ সংরচনা তৈরী করতে গেলে আধ্যাত্মমুখী মানসিকতা থাকতেই হবে নতুবা সেবা-মনস্তত্ত্বে জাগরণ তথা বিকাশ সম্ভব নয়৷’ ---শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷
৬.মানুষ বলতে -- বিশেষ আকারের এক জৈববৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আধারে মনের সবকটি দিকের (ডুয়ার আই , সীয়ার আই ও অপারেটিভ আই---চিত্ত, অহং ও মহৎ এর) বিকশিত এক মননশীল জীবপ্রজাতি কে বোঝায়৷ কাজেই ব্যষ্টিজীবনে -সমষ্টি বা সমাজজীবনে -আধ্যাত্মিকজীবনে যে ক্ষেত্রেই হোকনা কেন মানবজীবনের সাফল্য -সার্থকতা -লক্ষ্যপূর্তি সবের মূলে রয়েছে মনের বিস্তার ঘটানো৷ অন্তর্মুখী আধ্যাত্মিক নিত্যপ্রয়াস (স্পিরিচ্যুয়্যাল্ কাল্ট) এর পাশাপাশি বহিরাঙ্গিক বৈবহারিক জীবনে সেবা - জনসেবা - সমাজসেবার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মনকে বিস্তার করার ক্রিয়াত্মিকা শক্তি ৷ সোজা কথায় ---জনসেবা না করতে পারলে মনের বিস্তার ঘটে না৷ অর্থাৎ মানুষের মত মানুষ হতে হলে জনসেবাকে বাদ দিলে --অন্য কোন পথ খোলা নেই৷ আজ থেকে আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে থেকে --সদাশিবের সময় থেকেই এই ’’চরম -সত্য’’টা প্রচারিত হয়ে আসছে৷ (ক্রমশ)
- Log in to post comments