করোনা বাইরাস (corona virus) আজ সারা পৃথিবীর আতঙ্ক হয়ে উঠেছে৷ গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহান প্রদেশে এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়৷ এখান থেকে চীনের অন্যত্র ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইরোগ ( চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কার্ভড-১৯) ছড়িয়ে পড়েছে৷ এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত চীনে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩০৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে, এখনও পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত ৮০,৫৫২৷ দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত ২৮ জন, আক্রান্ত ৬,২৮৪ জন, ইতালিতে মৃত ১০৭ জন, আক্রান্ত ৩,৫৫৮, ইরানে মৃত ১৩৭জন, আক্রান্ত ১,৭৪৭, ফ্রান্সে মৃত ৭, আক্রান্ত ৪২৭৷ এমনিভাবে বহু দেশেই এই রোগ অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে৷ ভারতেও এ পর্যন্ত ৬১ জনের আক্রান্তের সংবাদ এসেছে৷ সর্বত্রই এখন করোনার আতঙ্ক৷ বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যবাহী বসন্তোৎসবও এরই জেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
সর্বত্রই সরকার এই রোগ প্রতিরোধ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে৷ জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োজনীয় সতর্কতা আনার জন্যেও আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে৷ হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বমি প্রভৃতি হলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে বা উপযুক্ত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷
এই প্রসঙ্গে বলি কেবল করোনা বাইরাস নয়, ইদানিংকালে নানান্ ধরণের মারাত্মক বাইরাস জনিত মারণ রোগ বৈজ্ঞানিকদের ভাবিয়ে তুলেছে৷ কেননা এই ভাইরাস বাহিত নানান্ ধরণের মারণরোগের মাঝে মাঝেই প্রাদুর্ভাব হচ্ছে৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানী এইসব বাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন৷ এই ভয়ঙ্কর বাইরাসকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় বৈজ্ঞানিকদের কাছে এটাই এখন বড় সমস্যা৷
এই বাইরাসের প্রকৃত স্বরূপ, গতি প্রকৃতি সবই বৈজ্ঞানিকদের অজানা৷ বাইরাস কি জীবিতসত্তা? বাইরাসের সঙ্গে ব্যাক্টিরিয়ার পার্থক্য কী?
বাইরাস ব্যাক্টিরিয়ার চেয়ে ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দুইকেই দেখতে হয়৷ ব্যাক্টিরিয়া অপেক্ষাকৃতভাবে বড়৷ সবচেয়ে ক্ষুদ্র যে ব্যক্টিরিয়া তার চেয়েও ক্ষুদ্রতর হ’ল বাইরাস৷ ব্যক্টিরিয়াতে রয়েছে জীবিত কোষ যা প্রোটোপ্লাজম দিয়ে তৈরী৷ এই প্রোটোপ্লাজম্কেই জীবনের আদি উৎস বলে মনে করা হয়৷ বৈজ্ঞানিকদের অভিমত তা-ই৷ কিন্তু বাইরাস তো প্রোটোপ্লাজম দিয়ে তৈরী নয়৷ তবে কি বাইরাস একেবারে জড়বস্তু (পার্টিকল)? তা-ও নয়৷ কারণ বাইরাসের জন্ম, বংশবৃদ্ধি ও মৃত্যু রয়েছে৷ বলা হয়, এই বাইরাস নাকি অন্য কোনো জীবকোষের সাহায্য নিজেদের বংশবিস্তার করে৷ তাহলে একে জড়বস্তু (পার্টিকল্) বলা যাবে কীভাবে? তাই ‘বাইরাস’কে বৈজ্ঞানিকরা পুরোপুরি জড়ও বলতে পারছেন না, আবার যেহেতু এতে প্রোটোপ্লাজম নেই, তাই ব্যক্টিরিয়াও (ক্ষুদ্র-জীবিত সত্তা) বলতে পারছেন না৷
এই পরিস্থিতিতে প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের যুগান্তকারী ‘মাইবাইটাম’ তত্ত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক৷
এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকরা কার্বন (Carbon) অণু বা কার্বন পরমাণুর সংযোগে সৃষ্ট প্রোটোপ্লাজমকে (জীবপঙ্ক) প্রাণের প্রাথমিক অবস্থা বলে মনে করেন৷ কিন্তু মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, না প্রোটোপ্লাজম বা কার্বন পরমাণু সঞ্জাত যৌগ নয়, মাইক্রোবাইটামই (অণুজীবৎ) প্রাণের উৎস৷ মাইক্রোবাইটাম বা বাংলায় ‘অণুজীবৎ’ নাম শ্রী সরকারেরই দেওয়া৷ আর এই মাইক্রোবাইটামে প্রোটোপ্লাজমে নেই, কার্বন পরমাণুর সম্পর্ক নেই৷ বরং তিনি বলেছেন, অজস্র মাইক্রোবাইটাম্ দিয়ে এই কার্বন পরমাণুর সৃষ্টি হয়েছে৷ তাঁর নিজের ভাষায়---‘প্রাণের মূল কারণ এককৌষিক প্রোটোজোয়া বা অণুজীবপঙ্ক নয়৷ প্রাণের উৎস হ’ল এই মাইক্রোবাইটাম৷ এই মাইক্রোবাইটাম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার৷ কাজটা অবশ্যই বিরাট৷ তবু বলা, অবিলম্বে এই বিষয়ে গবেষণার সূত্রপাত হওয়া দরকার নইলে আজকের সমাজের বহুবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে না৷’
ত্রিকালদর্শী মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (যিনি ধর্মজগতে শ্রীশ্রী আনন্দ মূর্ত্তিরূপে সমধিক পরিচিত) তাঁর প্রজ্ঞা-দৃষ্টির সাহায্যে বলেছেন, এই মাইক্রোবাইটামের রহস্য যখন মানুষ উদঘাটিত করতে পারবে, তখন চিকিৎসা শাস্ত্রে, রসায়ন শাস্ত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটাতে পারবে৷ মানব সমাজ নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও এর সাহায্যে উন্নতি ঘটাতে পারবে৷ তিনি তাঁর মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বে বলেছেন, এই মাইক্রোবাইটামকে প্রাথমিকভাবে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ---(১) যে সমস্ত স্থূল (crude) মাইক্রোবাইটাগুম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আওতায় আসবে৷ (২) যারা অণুবীক্ষণের যাওতায় আসবে না, কিন্তু তাদের ক্রিয়াগত অভিব্যক্তির দরুণ বা ক্রিয়াগত স্পন্দনের দরুণ ইন্দ্রিয়াণুভূতির আওতায় আসবে, (৩) যা সাধারণ ইন্দ্রিয়ানুভূতির আওতায় আসবে না, কিন্তু যারা মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে যথেষ্ট উন্নত অবস্থাপ্রাপ্ত তারা ইন্দ্রিয়াণুভূতির আওতায় আসবে৷
এদের মধ্যে এই যারা একটু স্থূল ও যাদের অণবীক্ষণের মাধ্যমে দেখা যাবে, তাদেরই বর্তমানে বলা হচ্ছে ‘বাইরাস’৷ এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন মারাত্মক রোগের বাহক৷ অন্যান্য সূক্ষ্ম মাইক্রোবাইটামেও পজিটিব্ (যা মানুষের দেহ ও মনের পক্ষে শুভ ফলদায়ক) ও নেগেটিভ (যা মানুষের দেহ ও মনের পক্ষে অস্বস্তিকর বা অহিতকর) মাইক্রোবাইটাম রয়েছে৷
মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের প্রবক্তা এও বলেছেন সাত্ত্বিক খাদ্যাভ্যাস , নিয়মিত যোগাসন ও ধ্যানানুশীলন,ভজন, কীর্ত্তন প্রভৃতি শরীরে ইম্যুনিটি পাওয়ার ও মনের মধ্যে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে ও তা পজিটিব্ মাইক্রোবাইটামকে আকর্ষণ করে ও নেগেটিব্ মাইক্রোবাইটামকে প্রতিহত করে৷ এইভাবে তথাকথিত বাইরাসের আক্রমণ থেকে মানুষ রেহাই পাবার শক্তি অর্জন করবে৷
বিভিন্ন বাইরাস জনিত ও সাইকো-সোমাটিক (মেন্টাল ষ্ট্রেস থেকে সৃষ্ট) রোগ থেকে মুক্ত হবার এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দাওয়াই৷
মানুষের শরীরের মধ্যেই একটা হাসপাতাল রয়েছে৷ বাইরের যে কোন রোগজীবাণুর সঙ্গে যুঝতে শরীরে ভেতরে বিশেষ শক্তি বা সৈন্যদল --- ‘এ্যান্টিবডি’ রয়েছে৷ এটা মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা৷
মানুষ উচ্ছৃঙ্খল খাদ্যাভ্যাস ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করলে এই অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়৷ খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে বললে বলতে হয়,প্রাকৃতিক নিয়মে নিরামিষ আহারই মানুষের পক্ষে উপযুক্ত৷ প্রকৃতিতে যে সমস্ত প্রাণী আমিষাশী তাদের সরু ধারালো ক্যানাইন টিথ থাকে, মানুষের তা নেই৷ বরং প্রকৃতিতে যে সমস্ত প্রাণী ফল, পাতা বা শস্য আহার করে তাদের মতই মানুষের দাঁতের গঠন, অন্ত্রের গঠনও তাদের মত৷
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকরাও তাই বলেছেন, নিরামিষ ভোজন, যোগাসন,ধ্যানভ্যাস প্রভৃতি ক্যানসার, হার্টের রোগ প্রভৃতি বিভিন্ন মারণরোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়৷
আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন জীবজন্তু, পোকা মাকড়, মাছ, (টাটকা বা শুটকি) এসব থেকে বেশীরভাগ বাইরাস জনিত রোগের সৃষ্টি হয়৷ কারণ, ওই সমস্ত জীব-জন্তু বা প্রাণীদেহে বাইরাস সহজে বাসা বাঁধে ও পরে তা সহজে মানুষের শরীরে চলে আসে৷ তাই খাদ্য হিসেবে নিরামিষ ও সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করাই শ্রেয়৷ তবে যে কোনোভাবে রোগাক্রমণ শুরু হয়ে গেলে অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত চিকিৎসা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত--- সে ব্যাপারে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই৷ কিন্তু রোগের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করতে, শরীরস্থ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে,শরীরের গ্রন্থি সমূহের হরমোন সিক্রেশন প্রয়োজনীয় মাত্রায় রাখতে, সঙ্গে সঙ্গে মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখতে, সাত্ত্বিক জীবন জীবনচর্চা ও নিয়মিত যোগাভ্যাস যে প্রয়োজন, এতে কারুর দ্বিমতের অবকাশ থাকা উচিত বলে মনে করি না৷
- Log in to post comments