কর্কটী রাক্ষসী
শিব তাঁর বৈদ্যক শাস্ত্র কাকে প্রথম শিখিয়েছিলেন তা’ এখন আর হলপ করে ৰলা যায় না৷ তবে যদ্দুর মনে হয়, তিনি প্রথমে তা’ শিখিয়েছিলেন কর্কটী রাক্ষসী নাম্নী জনৈকা অনার্য কন্যাকে৷ অনেকে সেকালে তাচ্ছিল্য করে অনার্যদের কখনো দানব, কখনো দৈত্য, কখনো রাক্ষস ইত্যাদিতে অভিহিত করত৷ সেকালের ভারতে কেবলমাত্র এই কর্কটী রাক্ষসীই বিসূচিকা (ওলাওঠা বা কলেরা) ও কর্কট রোগের (ক্যান্সার রোগ) চিকিৎসা করতে পারতেন৷ পরে ডগমা–প্রেষিত মানুষেরা তাঁকে হত্যা করে৷ (‘‘গণবতীসূত’’
‘শব্দ–চয়নিকা’, ১৬শ পর্ব)
খসাত্মজ ঃ খস+আত্ম+জন+ড= খসাত্মজ৷ ‘খসাত্মজ’ শব্দের অর্থ রাক্ষসীপুত্র – সে স্বয়ং রাক্ষস নাও হতে পারে৷ পুরাণে এই ধরণের কাহিনীও অনেক আছে৷ রাক্ষসী মাতার গর্ভে জন্মেছে উন্নত ৰুদ্ধির মানুষ বা দেবতা৷ কর্কটী রাক্ষসীর পুত্র সুতনুক ছিলেন একজন আদর্শ চরিত্রের জনহিতব্রতী বৈদ্য৷ কর্কটী রাক্ষসীর স্বামী অনুভসেন ছিলেন মানব ও রাজা৷ কর্কটী রাক্ষসী কর্কট অথাৎ ক্যান্সারের ঔষধ আবিষ্কার করেছিলেন৷ রাক্ষসীর পুত্র হলেও সুতনুক রাক্ষস ছিলেন না৷ তবু তাঁকে ‘খসাত্মজ’ ৰলা অবশ্যই চলবে৷ আসলে শাস্ত্রে ‘আত্মজ’ ৰলতে ৰোঝায় প্রথম সন্তানকে (পুত্র বা কন্যা)৷ অন্যান্য সন্তানকে ‘আত্মজ’ না ৰলে ৰলা হয় ‘কামজ’৷
এক্ষেত্রে দুঃখের সঙ্গেই ৰলতে হচ্ছে যে কর্কটী রাক্ষসীর আবিষ্কৃত কর্কট রোগের ঔষধ আজ বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে৷ রোগ নির্ণয়ে ও ঔষধের সন্ধানে গবেষণার জন্যে তাঁকে মৃতদেহ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হ’ত৷ তাই সেদিনকার অনগ্রসর মানুষ ভেবেছিল, তিনি নরমাংস ভক্ষণের জন্যেই ৰুঝি মৃতদেহ খুঁজে বেড়াতেন৷ ৰলা হয়, অকৃতজ্ঞ মানুষ কর্কটী রাক্ষসীকে পুড়িয়ে মেরেছিল৷ আর তাকে পোড়াবার সময় অগ্ণির যে লেলিহান শিখা উৎসারিত হয়েছিল তার অভিশাপেই নাকি তৈরী হয়েছিল বিসূচিকা ব্যাধি ও তাঁর আশীর্বাদেই ভেসে এসেছিল মধুমেহের (diabetes)–আজকাল ৰলা হয় বহুমূত্র) ঔষধ৷ কলেরা ব্যাধিটির সংস্কৃত নাম ‘বিসূচিকা’, ৰাংলা নাম ‘ওলাওঠা’, ইংরেজী নাম cholera, আর ফারসীতে ‘হৈয়জা’৷ ওলাওঠা বা কলেরার যথার্থ ঔষধ এখন আর মানুষের হাতে নেই৷ স্যালাইন দেওয়া তো কোন ঔষধ হ’ল না৷ মানুষকে এর যথার্থ ঔষধ খুঁজে বার করতে হবে৷ দেবী ওলাইচণ্ডীর (ওলাবিবি) পূজোয় রোগটা কতখানি সারতে পারে তা’ ৰুদ্ধির অগম্য৷ (‘‘খসাত্মজা’’, ‘শব্দ–চয়নিকা’,
১৪শ পর্ব)
জাতিভেদ ও নারীর মর্যাদা হ্রাস
প্রাচীন সমাজে নারী–পুরুষের সমান অধিকার ছিল৷ পরবর্ত্তীকালে যখন গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি কিছু সংখ্যক নারী প্রজ্ঞায়, বৈদুষ্যে, মানবিকতায় তথা মানসিকতায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে গেছলেন তখন একদল ষড়যন্ত্রকারী নারীর মনে হীনম্মন্যতা সৃষ্টির জন্যে একের পর এক তাঁদের অধিকার খর্ব করতে শুরু করল৷ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় নারী ও শূদ্রকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়৷ মানব ইতিহাসে সে ছিল এক মহা দুর্দিন৷ তখন মানুষ মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হ’ল৷ বলতে পারি, শোষণের সাম্রাজ্যবাদিতার ও উপনিবেশবাদের সেটাই ছিল বীজাত্মক প্রাথমিক অধ্যায়৷
অতি প্রাচীন কালে বস্ত্রবয়নের কাজ সাধারণতঃ নারীরাই করতেন কারণ বস্ত্র বয়নকালে যে ভাবে খুঁটিয়ে দেখে কাজ চালাতে হয়, সে গুণ পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যেই ছিল বেশী৷ আজও পৃথিবীর অনেক মানবগোষ্ঠীতে বস্ত্রবয়নের কাজ নারীরাই করে থাকেন আর তা করে থাকেন স্বাভাবিক ভাবেই৷ নারীকে যখন সমাজে অপাংক্তেয় করে দেওয়া হ’ল তখন বস্ত্রবয়ন কাজে রত থাকাটাও ছোট কাজ বলে গণ্য হতে থাকল৷ কিছুসংখ্যক মানুষের কারসাজিতেই এটা হয়েছিল৷ মানুষ গায়ের ঝাল মেটাবার জন্যেই অনেক সময় এই ধরণের কাজ করে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল বাঙলার সুবর্ণবণিকদের প্রতি রাজা বল্লালসেনের ঝাল মেটানোর ইতিকথা৷
বাঙলার রাজকোষ তখন নিয়ন্ত্রণ করতেন কিছু সংখ্যক সুবর্ণবণিক প্রধান৷ তাঁদের মূল কেন্দ্র ছিল সুবর্ণগ্রাম৷ বল্লাসসেন ছিলেন বিলাসী ও অসংযত স্বভাবের মানুষ৷ এজন্যে তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেন অতি মাত্রায় দুঃখিত থাকতেন৷ বল্লালসেন প্রায়ই রাজকোষ থেকে অর্থ চেয়ে পাঠাতেন৷ রাজার আদেশ–তাই রাজকোষ–পরিচালক সুবর্ণবণিকেরা গোড়ার দিকে কোন আপত্তি করতেন না৷ কিন্তু পরে তাঁরা যখন দেখলেন রাজা প্রত্যর্পণের কথা দিয়েও অর্থ প্রত্যর্পণ করেন না, এতে বাঙলার আর্থিক সংরচনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন রাজকুমার লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে কথা কয়ে নিয়ে তাঁরা একবার বল্লালসেনকে বললেন–‘‘মহারাজ, এভাবে টাকা তুলে নিলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে’’৷ বল্লালসেন তখন তাঁদের বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শে ক্রুদ্ধ হয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিমান ধীশক্তিসম্পন্ন এই সুবর্ণবণিক জনগোষ্ঠীকে ‘জল–চল’ বলে ঘোষণা করলেন অর্থাৎ এইভাবে তিনি তাঁর গায়ের ঝাল মেটালেন৷
প্রাচীনকালে ঠিক তেমনি কিছুসংখ্যক স্বার্থপর পুরুষ নারীদের অধিকার খর্ব করে স্ত্রী ও শূদ্রকে অনন্তকাল ধরে পায়ের তলায় পিষে মারার ষড়যন্ত্র সেরে রাখলেন৷
(‘‘ঊত’’, ‘শব্দচয়নিকা’, ২য় পর্ব)
অনেকে বলে থাকেন যে স্ত্রী ও শূদ্র বেদপাঠের ও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী নয়৷ এও তো ভেদবুদ্ধি৷ ভারতবর্ষের বেদমন্ত্রের রচয়িত্রী নারীরাও ছিলেন৷ অতএব এরূপ উক্তি অযৌক্তিক৷
(‘‘সাধনার রূপ’’, ‘সুভাষিত–সংগ্রহ’, ১ম খণ্ড)