মানুষের এই শরীরটা তৈরী হয়েছে অগণিত ছোট ছোট জীবকোষ দিয়ে৷ এরা দুই ধরনের–(১) এককোষী (Protozoic cells) ও (২) বহুকোষী (Metazoic cells)৷ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এই প্রকার অসংখ্য জীবকোষ দিয়ে তৈরী৷ এক হিসেবে দেখতে গেলে মানুষের পুরা দৈহিক কাঠামোটাই একটা বড় রকমের বহুকোষী জীব ছাড়া কিছু নয়৷ প্রতিটি কোষের নিজস্ব মন, আত্মা সব কিছুই রয়েছে৷ তবে জীবকোষের মন মানুষের মনের থেকে ভিন্ন৷ এককোষী জীবের চেয়ে বহুকোষী জীবের মন অধিকতর বিকশিত৷ মানুষের মনটা হ’ল অণুমানস তথা অণুদেহের সমস্ত মানসশক্তির সমষ্টি৷ কাজেই মানবমন হ’ল একটা সামূহিক মন৷ ভূমামন যেমন ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সত্তার সঙ্গে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত আছেন, অণুমানসও তেমনই দেহের প্রতিটি সত্তার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত আর সমষ্টিগত ভাবে সকল জীবকোষের মনগুলোও অণুমানসের সঙ্গে সম্পর্কিত৷
সাধারণতঃ মানুষের দেহের এই কোষগুলো ২১ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকে ও তারপর তারা শরীর থেকে খসে পড়ে, আবার নোতুন কোষের জন্ম হয়৷ সাধারণতঃ আমরা যখন জোর করে আঙ্গুলে করে গা রগড়াই তখন শরীর থেকে কিছুটা ময়লা আঙ্গুলে লেগে যায়৷ আসলে এই ময়লা বাইরের নয়, দেহের ওপরকার শত শত কোষ মরে শুকিয়ে ময়লা হয়ে যায়৷
আমরা আমাদের শরীর রক্ষার জন্যে যে আলো, বাতাস, খাদ্য, পানীয় গ্রহণ করি, জীবকোষগুলি তা থেকেই উৎপন্ন হয়৷ কাজেই আমরা যে ধরনের খাদ্য, পানীয় গ্রহণ করি, তারই থেকেই যখন জীবকোষ তৈরী হয়, আর অগণিত জীবকোষের সামূহিক মানস–প্রকৃতি যখন মানুষের মনকে প্রভাবিত করে তখন সাধক মাত্রেরই উচিত খাদ্যাখাদ্য বিচার করে তা গ্রহণ করা৷ ধরা যাক্, কোনও মানুষ তামসিক আহার গ্রহণ করলো৷ ফলস্বরূপ নির্দিষ্ট সময়ে তমোগুণী জীবকোষের জন্ম হবে ও তারাই আবার সাধকের মনে তমোগুণী প্রভাব বিস্তার করবে৷ তাই আগে থেকেই মানুষ স্থান, কাল পাত্র বিশেষে সত্ত্বগুণী বা রজোগুণী খাবার খাবে৷ তাতে সত্ত্বগুণী ‘সেল’ তৈরী হবে৷ সেই অবস্থায় সাধকের সহজেই সাধনায় অভিরুচি জাগবে ও মনঃসাম্য অর্জন করে’ নিজেকে দৃঢ়ভাবে অধ্যাত্মভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করবে৷ প্রায় ২১ দিন পর পর পুরাতন জীবকোষগুলো ঝরে পড়ে ও তাদের জায়গায় নোতুন জীবকোষের জন্ম হয়, কিন্তু প্রৌঢ়ো বয়সে বা বার্দ্ধক্যে জীবকৌষিক ত্রুটির ফলেই মুখের লাবণ্য ও কোমলতা দূর হয়, চামড়া শিথিল হয়ে পড়ে৷ দেহের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গগুলো বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে৷ যে সমস্ত রোগী দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন, সাধারণতঃ অভিজ্ঞ চিকিৎসক সেই সমস্ত রোগীদের কমপক্ষে ২১ দিন পুরা বিশ্রাম নিতে বলেন৷ কারণ হ’ল এই ২১ দিন পুষ্টিকর খাদ্য খেলে ও সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিলে শরীরে নোতুন জীবকোষের জন্ম হবে, দেহে ও মনে তেজ ও বল ফিরে আসবে৷
একথা বলাই বাহুল্য যে এই জীবকোষগুলোও জীবিত প্রাণী ও জন্ম–জন্মান্তর ধরে বিভিন্ন রূপ বিবর্ত্তনের মাধ্যমেই তারা আজ মানুষের শরীরে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ও ভবিষ্যতে [এক ] একটি জীবকৌষিক মন ক্রমোন্নতির মাধ্যমে মানুষের মনেও রূপান্তরিত হবে৷
কোনও মানুষের শরীরের যে জ্যোতিঃ তা হ’ল তার দেহস্থিত সমস্ত জীবকোষের সামূহিক জ্যোতিঃ৷ বৃদ্ধ বয়সে দেহের বহু জীবকোষ হীনবল হয়ে পড়ায় মানুষের শরীরের জ্যোতিঃ কমে যায়৷ এমনকি দীর্ঘদিন রোগে ভুগলে অল্পবয়স্ক্ যুবকদেরও দেহের লাবণ্য কমে যায়৷ মানুষের কেবলমাত্র মুখমণ্ডলেই রয়েছে কয়েক কোটি জীবকোষ৷ মানুষ যখন খুব বেশী ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে তখন শরীরের বেশ কিছুটা রক্ত হঠাৎ মুখমণ্ডলে এসে পড়ায় মুখ লাল হয়ে পড়ে ও তাতেও বহু জীবকোষ মারা পড়ে৷ তাই খুনী বা নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকেদের মুখ দেখলেই চেনা যায়৷
সাত্ত্বিক ভোজন ও সাধনার ফলে মানুষের শরীরের জীবকোষগুলোও সাত্ত্বিক হয়ে পড়ে৷ তখন তাদের থেকে শাদা জ্যোতিঃ বেরিয়ে আসে ও সাধকের শরীরের চারিদিকে এক জ্যোতির্বলয় তৈরী হয়৷ সাধারণতঃ মহাপুরুষদের ছবিতে তাঁদের চারিদিকে যে শ্বেত ‘জ্যোতির্মণ্ডল’ দেখা যায় তার পেছনেও এই কারণ৷
এখন দেখব, মানুষের শরীরে জীবকোষ তৈরী হয় তার খাদ্য, পানীয়ের ওপর নির্ভর করে’৷ আবার এই জীবকোষগুলোর প্রকৃতি অনুযায়ী মানুষের প্রকৃতি গড়ে ওঠে৷ তাই প্রমাণিত হয় যে খাদ্যের সঙ্গে মনের যথেষ্ট নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে৷ তাই সকল মানুষেরই খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে বিধিনিষেধ মেনে চলা অবশ্যই উচিত৷ খাদ্যের গুণাগুণ বিচার না করে, যে–কোনো প্রকার খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করলে তাতে মানুষের অধোগতির সম্ভাবনা প্রচুর৷ ‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধি’ –সাধকের পক্ষে এটা অবশ্য পালনীয়৷ তাই সেই সকল খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করা উচিত যা খেলে আমাদের শরীর ও মনের পবিত্রতা বজায় থাকে৷
জগতের সকল বস্তুতেই সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ ওই তিনগুণের মধ্যে একটা বিশেষ গুণকে প্রধানভাবে দেখা যায়৷ খাদ্যও তাই গুণানুযায়ী সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক–এই তিনভাগে বিভক্ত৷
সাত্ত্বিক আহার ঃ যে যে খাদ্যসামগ্রী দেহ ও মন উভয়ের পক্ষে হিতকর তাই সাত্ত্বিক৷ সাত্ত্বিক আহারে সত্ত্বগুণী জীবকোষ তৈরী হয়৷ উদাহরণ ঃ চাল, গম, যব, সর্বপ্রকার ডাল (মুসুর ডাল বাদে) ও ফলমূল, দুগ্ধ ও দুগ্ধ–জাত দ্রব্য শাক–সব্জী ইত্যাদি৷
রাজসিক আহার ঃ যে খাদ্য শরীরের পক্ষে হিতকর কিন্তু মনের পক্ষে হিতকর হলেও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে কিন্তু মনের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, তাই রাজসিক পর্যায়ভুক্ত৷
তামসিক আহার ঃ যে খাদ্য মনের পক্ষে অনিষ্টকারক ও শরীরের পক্ষে হিতকর হতেও পারে, আবার নাও পারে তা এই পর্যায়ে পড়ে৷ যেমন বাসি ও পচা দ্রব্য, গো–মহিষাদি ৰৃহৎ জন্তুর মাংস, সর্বপ্রকার মাদক দ্রব্য ইত্যাদি৷ অনেক সময় কতকগুলো খাদ্যসামগ্রীর গুণাগুণ না জেনেই মানুষ তা ব্যবহার করে থাকে৷ যেমন সদ্য–প্রসূতা গাভীর দুগ্ধ, শাদা বেগুন, খেসারীর ডাল, লাল পুঁই, সরষে শাক ইত্যাদি, কারণ এদের অনেকেরই উৎপত্তি হয়েছিল গলিত বস্তু থেকে৷
মনঃসাম্য অর্জন করার জন্যে, আধ্যাত্মিক প্রগতির জন্যে তাই মানুষকে খাদ্যের গুণাগুণের দিকে লক্ষ্য রাখতেই হবে৷ নতুবা সাধনাও করতে যাব, আবার অখাদ্য–কুখাদ্যও খাব তা চলবে না৷