১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমাতে মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (পরবর্তীকালে যিনি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি নামে পরিচিত হয়েছেন) কলিকাতায় গঙ্গার তীরে কাশি মিত্র ঘাটে কুখ্যাত ডাকাত কালীচরণ কে মানব ধর্মের সাধনায় দীক্ষিত করে সৎ পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন৷ তরুণ প্রভাত রঞ্জন সরকার তখন বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কলিকাতার কাশীমিত্র ঘাট এলাকার ত্রাস৷ ডাকাত কালীচরণ বা কালী ডাকাত নামেই এলাকার সবাই জানত৷ তরুণ প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রত্যহ অপরাহ্ণে কাশীমিত্র ঘাটে সান্ধ্য ভ্রমণে আসতেন৷ সেদিনও এসেছিলেন---দিনটি ছিল ২৯শে আগষ্ট মঙ্গলবার,শ্রাবণী পূর্ণিমা৷ গঙ্গার তীরে একটি বটগাছের নীচে বসেছিলেন তরুণ প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ পিছন থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছিল কালীচরণ৷ পিছন দিকে না তাকিয়ে প্রভাতরঞ্জনের কালীচরণ ডাক শুনে চমকে উঠেছিল কালী ডাকাত৷ প্রভাতরঞ্জনের সংস্পর্শে এসে মনের সব কালীমা মুছে ডাকাত কালীচরণ হলেন সাধক কালীচরণ৷
কালীচরণ শুধু একা নয়, প্রত্যেক মানুষের মনেই একটা করে কালিচরণ লুকিয়ে আছে৷ মনের সেই কালীচরণ অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি যা মানুষকে কুপথে টেনে নিয়ে যায়, তার বিনাশ করেই মানুষকে মানুষ হতে হয়৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন---‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশু পাখি সহজেই পশু পাখি, কিন্তু মানুষকে প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ হতে হয়৷ এই চেষ্টার নামই মানব ধর্মের সাধনা৷ তাই ধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বকবি বলেছেন--- পশু বলছে সহজ ধর্মের পথে ভোগ করো, মানুষ বলছে মানব ধর্মের সাধনা কর৷ এই মানব ধর্মের সাধনা ছাড়া মানুষ কখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারে না৷ কারণ প্রত্যেক মানুষের মনেই কিছু সহজাত বৃত্তি আছে, যার কিছু কিছু তাকে বিকাশের পথে সুপথে নিয়ে যেতে পারে, কিছু কিছু তাকে বিনাশের পথে অবনতির পথে নিয়ে যায়৷ আজকের সমাজে অশ্লীল নগ্ণ শিল্পসাহিত্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানব মনের এই কুপ্রবৃত্তি গুলিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে, তাই আজ সমাজে এত ভ্রস্টাচার, অনাচার, ব্যভিচার৷ আর জি করের ঘটনাও এই প্রবৃত্তির তাড়নায়৷ তাই মধ্যরাতের দখল নিয়ে, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে, চিকিৎসার মত পরিষেবা বন্ধ করে একে প্রতিহত করা যাবে না৷ আর জি করের ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক পাশবিক ঘটনা৷ এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত আছে তারা যত ক্ষমতাশালী হোক তাদের কঠোরতম শাস্তি হোক এটা প্রতিটি শুভ চিন্তাধারার মানুষের কামনা৷ কিন্তু চিকিৎসার মত পরিষেবা বন্ধ করে প্রতিবাদটাও অমানবিক৷ এই ধরনের অমানবিক আন্দোলন সমাজকে পাপমুক্ত করতে পারেনা, আর একটা পাপের জন্ম দেয় মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যু ঘটিয়ে৷ সহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন যুক্তিযুক্ত৷ কিন্তু তাঁদেরও মনে রাখতে হবে তাঁরা এমন এক পেশার সঙ্গে যুক্ত যে পেশার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-মরন সম্পর্ক৷ এক মর্মন্তুদ অমানবিক হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানবিকতা যেন হারিয়ে না যায়৷ তাছাড়া সতর্ক থাকতে হবে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে রাজনীতির কদর্য পেশায় যুক্ত কুশিলবরা৷ তবু কোন আন্দোলন, অপরাধীর কঠোর সাজা কোন কিছুই সমাজ থেকে এই পাপ প্রতিহত করতে পারে না৷ মনের কালীচরণকে প্রতিহত করলেই সমাজ পাপমুক্ত হবে৷শ্রাবণী পূর্ণিমা---শুধু একজন কালীচরণ নয়, সমগ্র মানবজাতির মনের সমস্ত কু প্রবৃত্তির বিনাশ ঘটিয়ে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিন৷ সমাজকে পাপ মুক্ত করতে মনের কুবৃত্তির বিনাশ ঘটিয়ে মানব ধর্মের সাধনায় রত হওয়ার দিন৷ তবেই সম্ভব হবে আর জি করের মত, বানতলা, বিরাটি, হাতরাস উন্নাও সমাজের কোনায় কোনায় প্রতিনিয়ত যে ব্যভিচার ঘটছে তাকে প্রতিহত করা৷
- Log in to post comments