মানব-প্রগতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বে রয়েছে  তিনটি স্তর--- আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক বা কারণ৷ এ ছাড়া রয়েছে  একটা মানসাতীত  স্তর৷  মানবীয়  অস্তিত্বেও তিনটি স্তর  রয়েছে --- স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ৷ এ ছাড়া  এখানে  রয়েছে  এক প্রতিফলিত চৈতন্য৷  এই চৈতন্যের  স্তরে  বিকাশের  কোন প্রশ্ণ নেই৷ কারণ আত্মা গুণাতীত অতীন্দ্রিয় সত্তা৷  যেখানে  রয়েছে অপূর্ণতা  ও নশ্বরতা,  সেখানেই  রয়েছে  বিকাশের  সুযোগ৷ অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার  দিকে গতিই হ’ল প্রগতি৷ মানসাতীত  স্তরে  কোন প্রগতি নেই৷  কারণ তা পূর্ণ ও শাশ্বত৷ মানসিক স্তরে   এই প্রগতির পূর্ণ সুযোগ রয়েছে৷  স্থূল শরীর যে  পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরী সেই পাঞ্চভৌতিক  উপাদান ভূমামানসের স্থূল  অভিব্যক্তি  ছাড়া কিছুই নয়৷ এই পাঞ্চভৌতিক  সত্তার  সমন্বয়েই সকল সত্তার  দেহ  সংরচনা গড়ে ওঠে৷

সকল সত্তার যিনি  মূল উৎস তিনি হলেন পরম পিতা৷ তিনি  সমভাবে  সকলের ৷  এই বিশ্ব  তাঁরই প্রকাশ৷  তাই  এই বিশ্বকে  ভোগ করবার  ও নিরাপত্তা লাভের  জন্মগত  অধিকার   প্রতিটি সত্তার আছে৷  অতিরিক্ত সম্পদ  কুক্ষিগত  করার অধিকার কারও নেই৷  অতিরিক্ত ভৌতিক সম্পদ  লাভ করার বাসনা বা তা সঞ্চয় করা  সমাজের  বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ ও  ঈশ্বরের বিরুদ্ধচারণ জনিত  পাপ৷ এটা একটা বড় ধরণের  অনৈতিক  ও সমাজ -বিরোধী  কাজ৷  এইসব কায়েমী  স্বার্থের ও  সমাজ বিরোধী  কার্যকলাপের  বিরুদ্ধে  সংগ্রাম চালিয়ে  যাওয়া ন্যায় ও  ধর্ম সঙ্গত৷

এই ভৌত দেহ  অপূর্ণ  ও নশ্বর৷ কারণ তা স্থান, কাল, পাত্রের বন্ধনে আবদ্ধ৷  আপেক্ষিকতার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার এক অপ্রতিহত ও অদম্য স্পৃহা মানুষের রয়েছে৷ এই এষণা যদি মানুষের না থাকত,  তা হলে  তার কোন বৌদ্ধিক বিকাশই ঘটত না৷  যারা দৈহিক অস্তিত্ব  রক্ষার  জন্যে  দিন-রাত্রি কঠোর সংগ্রাম করে চলেছে  তারা তাদের মানসিক  উন্নতির  জন্যে  খুব কমই  সময় পায়৷  তাদের খাওয়া -পরার সমস্যাই  তাদের  মনের  বিকাশকে  স্তব্ধ করে দিয়েছে৷  মনুষ্যত্বের  বিকাশ  তথা  সার্বিক উন্নতির জন্যে প্রতিটি মানুষের  সমান সুযোগ  ও নূ্যনতম  প্রয়োজনের গ্যারান্টির  ব্যবস্থা করা সর্র্বগ্রে প্রয়োজন৷

ভৌতদেহ  স্থান-কাল-পাত্রের ন্ধন  থেকে মুক্তি  পেতে পারে না৷  ব্যষ্টিতে  ব্যষ্টিতে  এই ন্ধনের  ঘনত্বের  তারতম্য থাকে  বা থাকবে,  কিন্তু এই তারতম্যের  হার যাই হোক না কেন, প্রতিটি মানুষকে  তার বৌদ্ধিক  প্রগতির  জন্যে  সীমাহীন  সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷  এছাড়া স্বাভাবিক  মানসিক বিকাশ  ঘটা সম্ভব নয়৷ সংগ্রাম জীবনের  মূলমন্ত্র  আর কর্মহীনতাই  মৃত্যু৷ সংগ্রাম এড়িয়ে  যাওয়া  কপটতার  নামান্তর মাত্র৷

যারা হীনমনা ও কায়েমী স্বার্থবাদী, মানবতার মুক্তি ও সমাজের  প্রগতি  চায় না, তারাই নানান ধরণের  ‘ইজমে’র উদ্ভাবন ও প্রচার  করে৷ উদ্দেশ্যে এইসব ডগ্মা বা ভাবজড়তার  আড়ালে  থেকে সমাজের  অজ্ঞ জনসাধারণকে  শোষণ  করা৷  ‘ইজমে’র নামে  এরা  বিভিন্ন মত-পার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদের  জবপন  করে তাদের  শোষণযন্ত্রকে  সুরক্ষিত  করে৷ মানব-সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ মানুষে  মানুষে  কোন মূলগত  পার্থক্য নেই৷ সকল মানুষই তার সঞ্জীবনী রস  ও জীবনী শক্তি পেয়ে চলেছে সেই এক অদ্বিতীয় উৎস থেকে৷

তাই  বিচ্ছিন্নতাবাদী  মনোভাব ও বৈষম্যের  কথা মানবতা বিরোধী৷

ভূমার ক্ষেত্রে যেমন স্থূল জগতের ঊধের্ব রয়েছে৷ সূক্ষ্ম জগৎ৷ অনুচৈতন্যের  ক্ষেত্রেও তেমনি রয়েছে৷   মানুষকে  তার বৌদ্ধিক  প্রগতির  জন্যে অনলস  চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ অন্যথায় মানুষের  স্থূল  জাগতিক বস্তুর দিকে ছুটবে৷  আর অনবরত এই স্থূল চিন্তা-স্থূল তরঙ্গের  অধ্যারোপণের  ফলে মন শেষ  পর্যন্ত  জড়ে রূপান্তরিত  হয়৷  মন জড়ত্বের  মধ্যে বাঁধা  থাকতে  পারে না৷  সুতারাং প্রত্যেকেরই  উচ্চ ও সূক্ষ্ম  বিষয়ের  চিন্তা করা ভূমাচৈতন্যের  ভাবনা নেওয়া উচিত৷

স্থূল শরীর ও  সূক্ষ্ম  মানসিক দেহ পরমাত্মার  মানসদেহেরই  অংশবিশেষ৷ সুতরাং আমরা কাউকেই  অবজ্ঞা করতে পারি নাা৷ প্রত্যেকের তার দৈহিক অস্তিত্ব রক্ষার  জন্যে ভৌতিক সম্পদের  যথাযোগ্য ব্যবহার করার  যেমন অধিকার  রয়েছে, তেমনি  মানসিক প্রগতির জন্যেও প্রত্যেককে  সমান সুযোগ  দিতে হবে৷....

রেনেসাঁ আন্দোলনের  লক্ষ্য হ’ল  মানুষের সুক্ষ্মতর উচ্চতর  চিন্তার  রাজ্যকে আলোকিত  ও পুনরুজ্জীবিত করা৷

আমি চাই, প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম  ভৌতিক প্রয়োজন-পূর্তির গ্যারাণ্টি পাক৷  প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত  সম্ভাবনার  পূর্ণ সুযোগ পাক, প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির  সমান সুযোগ  পাক ও বিশ্বের  সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের  অধিকারী হোক৷ প্রতিটি  মানুষ সেই  শাশ্বত অনন্ত  সত্তার  দিকে এগিয়ে  চলুক৷ এই আন্দোলনের  মাধ্যমে  মানুষ জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য  সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠুক৷   (মূল ইংরেজী থেকে অনূদিত)