বলা হয়েছে, পরমাত্মার কৃপা হলে ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙঘয়তে গিরিম্’৷ অর্থাৎ যে মূক–বোবা সেও বাচাল হয়ে যায়, খুব কথা বলতে থাকে, আর পঙ্গুও পর্বত লঙঘন করতে পারে৷ পরমপুরুষের কৃপাতেই যে তা সম্ভব, এটা খুব সহজেই ক্ষোঝা যায়৷ কিন্তু আমি বলতে চাই– যে কোনো কাজই, মনে কর, মূক হয়তো বাচাল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুটা কথা বলছে, পঙ্গু পর্বত লঙঘন করছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে– এটা কি মানুষ তার নিজের শক্তির সাহায্যে করে? পঙ্গুর গিরিলঙঘন যেমন তার নিজের শক্তির সাহায্যে সম্ভব নয়, তেমনি যে বৃদ্ধ মানুষটি ধীরে ধীরে হাঁটছে, সেও নিজের শক্তির সাহায্যে চলছে না৷ তার পায়ে যে সামান্য শক্তিও আছে, লাঠির সাহায্যে সে যে চলছে, তাও তার নিজের শক্তিতে নয়৷ এও পরমপুরুষেরই শক্তি৷ মানুষের যা কিছু সামর্থ্য কোনো কিছুই তার নিজের শক্তি নয়৷ একথাটা খুব ভালভাবেই মনে রাখা উচিত যে প্রকৃতপক্ষে মানুষের নিজের কিছুই নেই৷ মনে কর একটা মানুষ আজ বলছে, ‘আমি খুব শক্তিশালী৷ আমার মধ্যে অনেক শক্তি রয়েছে৷’ সেই মানুষটি দু’দিন না খেলে দেখবে তৃতীয় দিন তার শরীরের কী অবস্থা হয় শরীর অবশ হয়ে আসবে, মুখ থেকে কথা সরবে না, চলতে পারবে না৷ যদি তার নিজের শক্তি থাকতো, তাহলে তো সে কাজ করতো, কথা বলতো, লড়াই করতো কিন্তু এখন তো সে কিছুই করতে পারছে না৷ পরমপুরুষ অন্নরূপে যখন তার শরীরে প্রবেশ করেন, তখনই তার দেহে শক্তি আসে৷
তাহলে মানুষের নিজের বলতে কিছুই নেই৷ পরমপুরুষের বাতাস, পরমপুরুষের জল, পরমপুরুষের অন্ন–এসব থেকেই মানুষ শক্তিলাভ করে৷ তার নিজের কিছুই নেই৷ তাই সে–ই সবচেয়ে বড় মূর্খ, সবচেয়ে বড় বুদ্ধু, সবচেয়ে বড় অজ্ঞ, যে ভাবে ঃ ‘এটা আম ার শক্তি, এটা আমি করেছি’৷ আর সে–ই ক্ষুদ্ধিমান্ যে ভালভাবেই ক্ষোঝে, ‘আমি যা কিছু করছি, পরমপুরুষের শক্তির সাহায্যেই করছি৷’ যখন মানুষের মনে এই ভাবনা থাকে যে পরমপুরুষের কৃপায় তাঁর যতটুকু শক্তি আমি পেয়েছি, ততটুকু কাজই আমি করতে পারি, তার চেয়ে বেশি নয়৷ যখন সে ভাবে, ‘আমার নিজের কোনো শক্তি নেই, তাঁর শক্তিতেই আমি যা কিছু করছি’, তখন তার মধ্যে অনন্ত শক্তি এসে যায়৷ যখন সে ভাবে, ‘আমার নিজের এতটা শক্তি আছে’, তখন সে ঠিক অতটুকুই কাজ করতে পারবে৷ কিন্তু যখন সে ভাববে এই সমস্তকিছু পরমপুরুষের শক্তি, তখন শক্তির অনন্ত স্রোত (হ্মন্দ্বব্জন্দ্বুুন্ত্রপ্ ব্দপ্সব্ভব্জন্তুন্দ্ব প্সন্দ্র ন্দ্বুন্দ্বব্জন্ধম্ভ) তার মধ্যে এসে যাবে, কারণ পরমপুরুষ অনন্ত শক্তির সাগর৷ তাঁর ভাবনা নিলে সাধকের মধ্যে অনন্ত শক্তি এসে যায়, আর সে তখন সবকিছু করতে পারে৷ এই কারণে সে–ই প্রকৃত ক্ষুদ্ধিমান৷
তোমরা যে পৃথিবীতে এসেছ, তোমাদের অনেক কিছু করতে হবে৷ দুনিয়াতে যা কিছু হচ্ছে, তার পেছনে কোন্ বৃত্তি কাজ করছে? –এষণা৷ এষণা হচ্ছে ইচ্ছাকে কর্মরূপ দেওয়ার প্রয়াস৷ যেখানে ইচ্ছা আছে, আর ইচ্ছা অনুসারে কাজ করার চেষ্টা রয়েছে, তাকেই বলে এষণা৷ ধর, তোমার এখান থেকে কালীঘাট যাওয়ার ইচ্ছা হ’ল৷ আর এই ইচ্ছাকে পূর্ণ করার জন্যে তুমি চলাও শুরু করে দিলে৷ এই যে বিশেষ প্রকারের ইচ্ছা, একেই বলা হয় এষণা৷ হিতের এষণাঞ্চহিতৈষণা৷ এই বিশ্বে যা কিছু–আছে– সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে এষণা থেকে৷
পরমপুরুষের এষণা থেকে বিশ্বের সৃষ্টি৷ আর এই যে অণুমন (ব্ভুন্ব্ধ প্পনুস্তু)–এতেও রয়েছে এষণা ঃ ‘আমি এটা করব, আমি ওটা করব’–এই ভাবনা৷ যখন দু’টো এষণা অর্থাৎ পরমপুরুষের এষণা ও মানুষের বৈয়ষ্টিক এষণা সমান হয়ে যায়, তখনই মানুষ বৈয়ষ্টিক জীবনে সাফল্য লাভ করে৷ মানুষ ভাবে, ‘আমি এই কর্মে সাফল্য অর্জন করেছি’৷ বাস্তবে কর্মসিদ্ধি ঠিক ওই মানুষটির হয়নি৷ পরমপুরুষের এষণারই পূর্ত্তি হয়েছে৷ পরমপুরুষ যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি হয়েছে৷ ওই মানুষটির ইচ্ছা এমনটিই ছিল, তাই তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে পরমপুরুষ নিজের ইচ্ছা অনুসারেই কাজ করে চলেন৷ মানুষের মনে আনন্দ হয়, যখন সে দেখে যে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে৷
এইজন্যে ক্ষুদ্ধিমান মানুষ আগে ভেবে দেখবে, পরমপুরুষের কী ইচ্ছা৷ তাঁর ইচ্ছা অনুসারে সে নিজের ইচ্ছাকে তৈরী করে নেবে৷ সেক্ষেত্রে অবশ্যই তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে৷ কারণ পরমাত্মার ইচ্ছা তো পূর্ণ হবেই৷ তাই ক্ষুদ্ধিমান মানুষ ব্যষ্টিগত ইচ্ছা বলে কিছুই রাখে না৷ সে দেখে, পরমাত্মার যে ইচ্ছা এর পিছনে কোন্ বৃত্তি কাজ করছে৷ জগতের কল্যাণ হোক্–কল্যাণ হোক্–এটাই পরমপুরুষের এষণা৷ এজন্যে শাস্ত্রে পরমপুরুষের এক নাম ‘কল্যাণসুন্দরম্’৷ পরমপুরুষ সুন্দর কেন? তিনি সর্বদা কল্যাণ চান, এজন্যেই তিনি সুন্দর৷ তাই দেখবে, যে তোমার শুভ কামনা করে সেই তোমার দৃষ্টিতে সুন্দর৷ এ কথাটা ভালো করে ভেবে দেখবে৷ যে তোমাকে ভালবাসে, তোমার চোখে সে–ই সুন্দর৷ সকল জীবের কাছে পরমপুরুষ সুন্দর, কারণ পরমপুরুষ কল্যাণসুন্দরম্৷
একথা মনে রাখবে, কল্যাণবৃত্তির জন্যেই পরমপুরুষ সুন্দর৷ তোমার এষণা, তোমার ইচ্ছা কল্যাণধর্মী হলে, তোমার এষণা আর কল্যাণসুন্দরম্–এর এষণা–এক হয়ে যাবে৷ তাঁর এষণা অবশ্যই পূর্ণ হবে, আর তোমারও জয়জয়কার হয়ে যাবে৷
আমি তোমাদের আগে বলেছিলুম না–মনে কর তোমাকে যেতে হবে কলকাতা থেকে পঞ্জাব৷ যাওয়ার সময় অনেক বাধা–বিপত্তি আসতে পারে, তোমার পায়ে অতটা শক্তি নাও থাকতে পারে, তাই তুমি নাও পঁৌছতে পার৷ কিন্তু ক্ষুদ্ধিমান মানুষ কী করবে? পঞ্জাব যাওয়ার ট্রেনে উঠে বসে পড়বে৷ পঞ্জাব মেল তো অবশ্যই পঞ্জাব পৌঁছবে৷ ওখানে তোমার যত আত্মীয়স্বজন বলবে, এই তো কলকাতা থেকে এসে গেছে৷ আসলে তুমি নিজে তো কলকাতা থেকে আসনি, ট্রেন তোমাকে পৌঁছে দিয়েছে৷ তুমি তো কেবল ট্রেনে উঠে বসেছিলে মাত্র৷ ঠিক তেমনি, তখনই তোমার কাজের প্রশংসা হবে, যখন তুমি পরমাত্মার ইচ্ছা–তরঙ্গের সঙ্গে তোমার ইচ্ছা–তরঙ্গকে মিলিয়ে দেবে৷ তাই কল্যাণসুন্দরম্ পরমপুরুষের ইচ্ছা–তরঙ্গের সঙ্গে নিজের তরঙ্গকে মিলিয়ে দাও৷ তাহলে তোমার জয়–জয়কার হয়ে যাবে৷ আমি তোমাদের এটাই বলব, তোমরা ক্ষুদ্ধিমান, কিন্তু আর একটু বেশী ক্ষুদ্ধিমান হও৷ নিজের ভাবনাকে পরমপুরুষের ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে দাও৷
(আনন্দবচনামৃতম্, সপ্তবিংশ খণ্ড)