মনের রোগের ফলস্বরূপ যে সব শারীরিক ব্যাধির সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে কয়েকটি বিশেষ ধরনের রোগ, তারা হ’ল কর্কট রোগ (cancer), অজীর্ণ, গেঁটে বাত৷ মনের রোগের ফলে উৎপন্ন রোগের সংখ্যা খুব বেশী না হলেও খুব কমও নয়৷ আমরা অনেক সময় দেখে থাকি, খিট্খিটে মেজাজের মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বদহজমে ভুগে থাকেন৷ ঙ্আজকাল অবশ্য মনের রোগ তথা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনার শিকার হয়ে অনেকেই হৃদরোগ, রক্তচাপ রোগ, ডায়াবিটিস ইত্যাদি রোগের কবলে পড়ছেন৷ এটাই হ’ল আজকের সভ্যতার অন্ধকারময় দিক৷
হিস্টিরিয়া ও মৃগীরোগ ঃ
জীবনে এমন ঘটনা অনেকই হয়ে থাকে–অনেক সময় দিনে কয়েকবারই হয়ে থাকে–যখন শারীরিক কোন ক্লেশ নেই কিন্তু মন আঘাত পেয়েছে, মনে শান্তি নেই৷ এমন জিনিস তিরস্কার–ভর্ৎসনাত্ হয়ই, আবার প্রিয়জনের অবহেলাতেও হয়ে থাকে৷ এই ধরনের অবহেলার সুদূরপ্রসারী পরিণতি হচ্ছে হিস্টিরিয়া ব্যাধি৷ এই ধরনের মানসিক ক্লেশকে ‘খেদ’ বলা হয়৷ যেহেতু মানসিক ক্লেশ থেকে হিস্টিরিয়ার উদ্ভব হয় সেহেতু একটু আদরযত্ন বা সহানুভূতি পেলেই হিস্টিরিয়া সেরে যায়৷ কুমারী কন্যা বয়স্কা হলে অথচ পিতামাতা কোন কারণে তাদের পাত্রস্থ করতে না পারলে মেয়েদের এই হিস্টিরিয়া হতে পারে৷ বিবাহের পর শ্বশুরগৃহে ভাল ব্যবহার পেলে তার হিস্টিরিয়া ব্যাধি সেরে যেতে পারে৷
যে সমস্ত বর্ণহিন্দু পরিবারের বিধবার বিবাহ হয় না সেই সকল বিধবাকে যদি শ্বশুরগৃহে ভাসুর–দেবর–জায়ের খোঁটা শুনতে হয় বা পিতৃগৃহে ভ্রাতৃবধূর মুখ ঝাম্টা শুনতে হয়, তারও হিস্টিরিয়া হয়৷ তাকে যত্ন করলে বা সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করলে অথবা পুনর্বিবাহ দিলে তার রোগ অবশ্যই সেরে যাবে৷
মামার বাড়ীতে (বা আত্মীয় বাড়ীতে) যে সকল বালককে মামীর খোঁটা সহ্য করতে হয় তারা, বিশেষ করে সেই ধরনের ছেলে যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, তারা তখন মানসিক ক্লেশ বা খেদ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে৷ বাড়ীর লোক তখন যদি তাকে নিকটে ডেকে বলত–‘খেটে তো ছিলি, এতেই তোর সার্থকতা৷ আমরা তো অনেকেই অনেকবার ফেল করেছি৷ এবার আরও বেশী করে খাট, আসছে বছর ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করবি, কত আনন্দের হবে বলত৷’ এই অবস্থায় ওই ছেলেটি শতকরা ৯৯ ভাগ নিশ্চিত যে সে আত্মহত্যা করবে না৷
চিৎ লুট্ করে চেতন৷ নঞার্থক ‘অ’–এর সংযোগে ‘অচেতন’৷ ‘চিৎ’ ধাতুর অর্থ হ’ল প্রত্যক্ষণ করা, বিচার–বিবেচনা করা, ভাবনা করা, চিন্তা করা৷ এই ‘চিৎ’ ধাতুর উত্তর করণে ‘ক্ত’ প্রত্যয় করে আমরা ‘চিত্ত’ শব্দটিও পাচ্ছি৷ ‘চেতন’ শব্দ নানান অর্থে ব্যবহূত হয়ে থাকে৷ চেতন মানে যে জেগে আছে, যার প্রাণ আছে, যার মনীষার বিকাশ হয়েছে, যার আত্মিক উদ্বোধন হয়েছে, যে মানুষ বিচারশীল, যার উন্নত বিবেচনা–শক্তি আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এরূপ অনেকগুলি অর্থ থাকলেও প্রয়োগ–ক্ষেত্রে আমরা সাধারণতঃ ‘চেতন’ শব্দটির মানে তিন ভাবে পেয়ে থাকি৷
বলাবাহুল্য, ‘অচেতন’ শব্দটিকেও আমরা তিন ভাবে ব্যবহূত হতে দেখি৷ স্থূল জাগতিক অর্থে কোন কারণে স্নায়ুতন্তু আহত হলে, তার প্রভাবে স্নায়ুকোষের স্বাভাবিকী কর্মশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হলে যে সাময়িক কর্মনিবৃত্তি দেখা দেয়, কথ্য বাংলায় আমরা যাকে ক্ষলি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা জ্ঞান হারানো, তার জন্যে ‘অচেতন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ আবার অনেক ক্ষেত্রে আঘাত স্নায়ুতন্তুতে লাগে নি, লেগেছে স্নায়ুকোষে৷ অতি সুখাত্মক বা অতি দুঃখাত্মক কোন ঘটনা স্নায়ুকোষকে আলোড়িত করে’ মানসিক স্তব্ধতা এনে দিলে, তার প্রভাবে স্নায়ুতন্তুও স্বাভাবিক ভাবে কাজ করা ক্ষন্ধ করে দেয়৷ এর ফলেও মানুষ লৌকিক অর্থে অচেতন হয়ে যায়৷ এই জন্যে কোন সুখের কথা বা কোন দুঃখের কথা হঠাৎ করে কারো কাছে উপস্থাপিত করতে নেই৷ ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে তা মানুষের মনে পৌঁছে দিতে হয়৷ স্নায়ুতন্তুতেও হঠাৎ গুরুতর আঘাত লাগতে দিতে নেই৷ এই সমস্ত ব্যাপারে সমাজগত ভাবে একটা বিবেচনা থাকা দরকার৷
মনে রাখা দরকার, ভূতে ধরা ও ‘ফিট হওয়া’ এক জিনিস নয়৷ ভূতে ধরলে সে বিড়বিড় করে কথা বলে৷ সেক্ষেত্রে তার চিন্তাগত আভোগকে নিয়ন্ত্রণ না করে’ বা না করতে পেরে স্থান–কাল–পাত্র ভুলে গিয়ে মনের চিন্তাকেই অভিব্যক্ত করে৷ এই হিস্টিরিয়া কিন্তু তা’ নয়৷ তা সে যাই হোক, এই হিস্টিরিয়াও এক ধরনের অচেতনতা৷ এপিলেপসি বা মৃগীরোগও মানসিক স্তর থেকে অর্থাৎ স্নায়ুকোষ থেকে স্নায়ুতন্তুতে সংক্রমিত হয়৷ তবে এই ব্যাধি প্রথমে আসে স্নায়ুতন্তুতে–তারপরে তা’ স্নায়ুকোষকে আলোড়িত করে৷ পরে তা’ ব্যাধিরূপে স্নায়ুকোষে অধিষ্ঠিত থাকে ও বিশেষ স্থানে–কালে ব্যক্ত হয়৷ এই হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অচেতনতা যা জড়জগতে আমরা দেখে থাকি বা পেয়ে থাকি৷ যে জিনিসটা যে মানুষ তার জীবনে কম অভিজ্ঞতা থাকায় কখনও ভাবেনি, সেই জিনিস বা ঘটনার সংস্পর্শে হঠাৎ এসে গেলে এই মৃগীরোগের উদ্ভব হয়৷ উপযুক্ত প্রপাঠের ঙ্মমনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা এই রোগের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়৷ রোগীকেও মানসিক চিকিৎসা ও তৎসহ কিছু মাত্রায় স্থূল ঔষধ প্রয়োগের দ্বারা এই ব্যাধির চিকিৎসা করতে হয়৷ যাই হোক, উপর্যুক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘অচেতন’ শব্দ ব্যবহার করে থাকি৷৪৭
বিষাদ বায়ু ঃ
ক্লান্ত মনঃ/ক্লান্ত মনস্ শব্দের ভাবাঢ়ার্থ হচ্ছে অবসন্ন হয়ে পড়ে থাকা, যোগাঢ়ার্থে বিষাদবায়ু বা Melancholia মানে মানসিক ব্যাধি৷ এই বিষাদ বায়ু বা Melancholia হচ্ছে এক ধরনের বাতোন্মাদ রোগ৷ এতে রোগী সব সময় নিজেকে অসহায় ..... একা একা অনুভব করে, কোন কাজে উৎসাহ পায় না৷ যে সব কাজগুলো অবশ্য করণীয় বা অবশ্য পালনীয় সেগুলি করতেও এগিয়ে আসতে চায় না৷ অধিকাংশ সময় বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে৷ যে বায়ুরোগে মানুষ এই ধরনের বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে তারই নাম বিষাদবায়ু৷
কিন্তু সকল মানুষই সমান ভাবে ক্লান্তমনঃ হয় না৷ ঙ্মআবার কোন ঘটনা থাকেক্ষ যে ঘটনা ব্যষ্টিবিশেষের মন থেকে হতাশারূপ বিষাদ বায়ুকে সরিয়ে দেয়, মনকে ভেঙ্গে পড়া অবস্থা থেকে তুলে উৎসাহে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে তা ক্লান্তিচ্ছিদ্ বা ক্লান্তিচ্ছেদ৷ সেক্ষেত্রে ঠিকমত মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি না নিলে অর্থাৎ উল্টোটা করলে মনোবল ভেঙ্গে গিয়ে মানুষ বিষাদ বায়ুতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ তাই মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময়–বিশেষ করে যে মানুষ ঘটনার বিবর্ত্তনে একটু অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়ে গেছে–তার সঙ্গে কথা বলার সময় সতর্ক হয়ে কথা বলা উচিত৷
উপযুক্ত মানসিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগটি নিরাময় যোগ্য৷ এই ধরনের রোগে আক্রান্ত মানুষটি যদি কোন ডঁচু আদর্শের সন্ধান পায়, মনোসংযোগের অভ্যাস বা অন্তর্মুখী ঈশ্বরোপাসনার উপযুক্ত নির্দেশনা পায়, তাহলে তার জীবনের ধারা সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তিত হয়ে যেতে পারে৷ সুস্থ, সফল, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে৷
বিষাদবায়ুগ্রস্ত ব্যষ্টির আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেলে শাদা বেড়েলার শেকড় কনিষ্ঠাঙ্গুলীর তিন অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ হাতে বেঁধে রাখলে উপকার পাওয়া যায়৷
কোপবেগ (ক্রোধ) ঃ
‘কোপবেগ’ শব্দের অর্থ হল কোপের বেগ.... কোপের ধারাপ্রবাহ৷ কোপের অতি প্রভাবে যখন উগ্র মাত্রায় মনশ্চাঞ্চল্য দেখা দেয় তখন সেই স্নায়ুকোষের (nerve-cells) প্রভাব অতি দ্রুত স্নায়ু তন্তুতে (nerve-fibres) প্রসারিত ও বিস্তারিত হয়ে পড়ে৷ স্নায়ুপুঞ্জ দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হতে থাকে যার ফলে গোটা শরীর ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে থাকে৷ রক্তসঞ্চালন দ্রুত হওয়ায় হৃদণ্ডের ওপর প্রভাব পড়ে৷ মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ (strain) পড়ে৷ কোপগত কারণে স্নায়ুকোষ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ব্যস্ত থাকায় স্নায়ুকোষ অন্যান্য কাজগুলি করবার সময় তেমন পায় না৷ এই কারণে অতিরিক্ত ক্রুদ্ধাবস্থায় ভাবগ্রহণ ক্ষমতা চলে যায়৷ কোপবেগে বশীভূত হবার ফলে মানুষের চিন্তার সামর্থ্য চলে যায়৷ তার ফলে স্থিতধী হওয়া সম্ভব হয় না৷ কোপবেগ–নিক্ষন্ধন অতিকম্পন হেতু স্নায়ুকোষ তার বৌদ্ধিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে৷ বৌদ্ধিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলায় স্নায়ুতন্তুকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য কম হয়ে পড়ে বা শেষ পর্যন্ত, সে করে উঠতে পারে না৷ অনেক সময় অনেক চালাক লোক শত্রুকে কোপবেগে ফেলে দিয়ে সাধারণ ভাবে তার বুদ্ধি নষ্ট করে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নেয়....নিজের মতলব হাসিল করে নেয়৷
সমাজ শাসনের জন্যে প্রয়োজনবোধে রাগ দেখানো বা কোপবৎ হওয়া চলতে পারে৷ কিন্তু মনের ভেতরে না রাগাই সঙ্গত৷ ক্রোধ এসে গেলে তার বিপরীত ভাবনা নিতে হয়৷