সম্প্রতি আমাকে একটি দুরূহ সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল৷ সমস্যাটা বা প্রশ্ণটা হয়তো কিছুটা দুরূহ কিন্তু উত্তরটা খুবই সরল৷ প্রশ্ণ ছিল, মহিলারা মুক্তি–মোক্ষের অধিকারী কি না৷
কিছুদিন আগে তোমাদের বলেছিলুম যে তন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘‘দেহভৃৎ মুক্তো ভবতি নাত্র সংশয়ঃ’’৷ আত্মজ্ঞান লাভের নূ্যনতম যোগ্যতা হ’ল এই যে সাধককে মানুষের শরীর পেতে হবে৷ এটাই হ’ল তার নূ্যনতম যোগ্যতা৷ কই, এখানে তো উল্লেখ করা হয়নি যে সে সাধক নারী বা পুরুষ হবে৷ এর থেকে এটাই পরিষ্কার যে নারী–পুরুষ উভয়েই মুক্তি–মোক্ষ লাভের সমান অধিকারী৷
একথা সত্য যে প্রায় সকল শাস্ত্রেই, তাদের ভাষ্যে, টীকা–টিপ্পনীতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে মেয়েরা মোক্ষ লাভের অধিকারী নয়৷ কিন্তু আনন্দমার্গের সিদ্ধান্ত বা ভাবাদর্শ বা বিচারধারা বেশ কিছুটা স্বতন্ত্র৷ আমাদের মার্গের মতে ও ব্যষ্টিগত ভাবে আমার মতে মুক্তি–মোক্ষে নারী–পুরুষের সমান অধিকার৷ এ ব্যাপারে নারী–পুরুষের অধিকার–ভেদ আমি সমর্থন করি না৷
সাধারণ ৰুদ্ধিতে ৰলে যে মানব অস্তিত্বের সকল কোষের মধ্যে – অন্নময়, কামময়, মনোময়, অতিমানস, বিজ্ঞানময় ও হিরণ্ময় কোষ – নারী পুরষে ভেদ কেবল নিম্নের দু’টি কোষে – অন্নময় ও কামময় কোষে৷ কোষ দু’টি সম্পূর্ণতঃ শরীর সম্পর্কিত৷ এই দু’টি বাদে অন্য কোষগুলির ব্যাপারে নারী পুরুষে কোন ভেদ নেই৷ জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অভিরুচি, অন্যান্য সূক্ষ্ণতর পরীক্ষা–নিরীক্ষা–ভিজ্ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে উপরের চক্রগুলির দ্বারা৷ নীচের কোষগুলি একান্তভাবে শুধু শরীর সংক্রান্ত বাপারে নিযুক্ত থাকে৷
মেয়েই হোক আর ছেলেই হোক, সন্তানের প্রতি বাপ–মায়ের ভালবাসার হেরফের হয় না৷ তেমনি বিশ্বের সমস্ত ছেলেই পরম পুরুষের পুত্রসন্তান, সমস্ত মেয়েই পরমপুরুষের কন্যাসন্তান৷ পরমপুরুষ তাঁর আপন পুত্র–কন্যাদের মধ্যে ভেদরেখা টানবেন কেন? যদি পুরুষের জন্যে মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত হয় তবে নারীর জন্যেও মুক্তির দ্বার সমান ভাবেই উন্মুক্ত৷ এটাই স্বাভাবিক যুক্তি৷ এর অন্যথা হবে কেন?
যারা কায়েমী স্বার্থের ধারক ও বাহক, যারা রেলিজনের জগতে (আধ্যাত্মিক জগতে নয়) কায়েমী স্বার্থের মৌরসি–পাট্টা নিয়ে শিকড় গেড়ে বসেছিল তারাই ঘোষণা করেছিল নারীর মুক্তি–মোক্ষের অধিকার নেই৷ এটাই ছিল মনস্তত্ত্ব৷ এই মনস্তত্ত্বের দ্বারা প্রেষিত তারা বহুকাল ধরে নারীর উপর শোষণ চালিয়েছিল৷ তাই তারা ৰলত – কেবল পুরুষই মুক্তি–মোক্ষের অধিকারী৷
এখন কথা হ’ল, এই সমগ্র বিশ্বই তো পরম পুরুষের সৃষ্টি৷ বরং এটা ৰলা আরও সঙ্গত হবে যে এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরম পুরুষের বিবর্তিত রূপ৷ মনে পড়ে আমি ইতোপূর্বে তোমাদের ৰলেছিলুম – আমরা অবতারবাদে বিশ্বাস করি না৷ সেই সঙ্গে এও ৰলেছিলুম যে এই ব্যক্ত জগতের প্রতিটি অণু–পরমাণু পরম পুরুষের অবতার৷ তোমরা সবাই তাঁর এক–একজন অবতার৷ কেবল ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও তাঁর অবতার৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখম্৷৷’’
‘‘হে পরমপুরুষ নারীরূপে, পুরুষরূপে, কুমার বা কুমারীরূপে তুমিই প্রকাশিত হয়েছ৷ তুমিই লাঠিতে ভর করে বৃদ্ধের বেশে পথ দিয়ে হেঁটে চল, তুমিই নিজেকে বহুধা–বিকশিত রূপে ব্যক্ত করে চলেছ৷ সেই তুমিই আবার সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান বিশ্বতোমুখ হয়ে সব কিছুই দেখে চলেছ’’৷
সবাই তাঁর এক একজন অবতার৷ ‘অবতার’ মানে উপর থেকে নীচে নেমে আসা সত্তা৷ এক ও অদ্বিতীয় পরম পুরুষ নানান রূপে, নানান সংরচনায় নিজেকে প্রকাশিত, ব্যক্ত করেছেন – স্থূল–সূক্ষ্ম, নারী–পুরুষরূপে৷ সৃষ্টির সকল সত্তাই, ক্ষুদ্র–ৰৃহৎ সবাই সেই পরম মোক্ষ ধামের অধিকারী৷ যারা মানুষের শরীর পায়নি তাদের সাধনা করার সুযোগ নেই কিন্তু পরমপুরষের কৃপায়, তাঁর আনন্দধারায় অভিষিক্ত হয়ে একদিন তারাও তা পাবে৷ পরমপুরুষ চাইলে ক্ষুদ্র কীট–পতঙ্গও মুক্তি–মোক্ষ পেতে পারে৷ এটা ঠিক যে কীট–পতঙ্গ মানুষের শরীর পায়নি বলে সাধনা করতে পারে না কিন্তু পরমপুরুষ চাইলে তারাও মুক্তি–মোক্ষ লাভ করতে পারে৷
ওই যে শাস্ত্রকাররা যারা ৰলে থাকে যে নারীর মুক্তি–মোক্ষের অধিকার নেই, আমি ৰলব ওদের ওই ধরণের কথা ৰলার অধিকারই নেই৷ এ ধরণের কথা ৰলা চরম ধৃষ্টতার পরিচয়৷
(‘আনন্দবচনামৃতম্’, ৩য় খণ্ড)