কিছুকাল আগেও কেউ কেউ বিধবা নারীর নামের সঙ্গে ‘শ্রীমতী’ বা ‘দেবী’ না লিখে ‘শ্রীমত্যা’ বা ‘দেব্যা’ লিখতেন৷ এরকম লেখা ব্যাকরণের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ তো বটেই, নারীর পক্ষে মর্যাদাহানিকরও৷ কারণ, বিধবা কী এমন অপরাধ করেছে যে জন্যে তাঁর শ্রীমতীত্ব বা দেবীত্বকে এইভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হবে বৈয়াকরণিক বিচারে ‘শ্রীমত্যা’ মানে ‘শ্রীমতীর দ্বারা’, ‘দেব্যা’ মানে ‘ ‘দেবীর দ্বারা’৷ অধবা সধবা–বিধবা নির্বিশেষে সব নারীর নামের সঙ্গেই ‘শ্রীমতী’ বা ‘দেবী’ শব্দ ব্যবহূত হতে পারে৷ এতে কোন সামাজিক বাধাও নেই, আবার বৈয়াকরণিক আপত্তিও নেই৷ ইংরেজী ‘মিস্’(Miss) শব্দের অনুকরণে বাঙলায় অধবা মেয়েদের নামের আগে যে ‘কুমারী’ শব্দটি ব্যবহারের প্রথা প্রচলিত রয়েছে সেটি কোন প্রাচীন রীতি নয়৷ ব্রাহ্ম আন্দোলনের সময় বাঙলায় এটি প্রবর্ত্তন করা হয়৷
প্রাচীনকালে অধবা কায়স্থ মেয়েদের নামে পিতৃকুলের পদবীর সঙ্গে ‘দুহিতা’ শব্দ ও সধবা মেয়েদের নামে শ্বশুরকুলের পদবীর সঙ্গে ‘জায়া’ শব্দ ব্যবহার করা হত৷ যেমন, কোন অধবা নারীর নাম হয়তো ‘অনীতা’৷ ধরা যাক সে বসু পরিবারের কন্যা৷ সেক্ষেত্রে সে নিজের নাম বলত অনীতা বসুদুহিতা৷ আবার তার যদি বিবাহ হত কোন ঘোষ, মিত্র বা দত্ত পরিবারে, বিবাহের পরে সে নিজের নাম বলত অনীতা ঘোষজায়া বা অনীতা মিত্রজায়া৷ এটাও কিন্তু কোন সুনিশ্চিত পরিচয় নয়৷ কারণ, বিবাহের পরে ঘোষ পরিবারের স্ত্রী হয়ে যদি ঘোষজায়া হলেন বিবাহের পরেও কি তিনি বসুদুহিতা থেকে যাচ্ছেন না? কারণ, তিনি যে বসু পরিবারের কন্যা – এটা তো ঐতিহাসিক সত্য৷ বিবাহের পরেও তো তিনি বলতে পারেন, আমার নাম অনীতা বসুদুহিতা৷
কোন কোন জনগোষ্ঠীতে বিধবা মেয়ের নামের সঙ্গে ‘বেওয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ এটাও আপত্তিকর ব্যবস্থা ও নারীর পক্ষে সম্মানহানিকর৷ ‘বেওয়া’ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘বিধবা’ শব্দ থেকে৷ বিধব > বিহবা>বেওয়া অবিধবা> অবিহবা> অইহওয়া> আইহ> এয়ো৷ বিবাহের স্ত্রী–আচারে অংশগ্রহণকারী নারীরা যেহেতু বিধবা নন, তাই কথ্য ভাষায় তাঁদের ‘এয়ো’ বলা হয়৷
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে কোন্ নারী অধবা, কে সধবা, কেই বা বিধবা – এ জন্যে পার্থক্যসূচক শব্দের দরকারটাই বা কী? পুরুষের ক্ষেত্রে অকৃতদার , কৃতদার ও মৃতদার পুরুষের জন্যে পৃথক কোন সূচক চিহ্ণ তো ব্যবহার করা হয় না৷ তাই মেয়েদের এইভাবে অধবা–সধবা–বিধবা পৃথকীকরণ পুরুষপ্রধান সমাজের একটি অবাঞ্ছিত ব্যবস্থা ছাড়া আর কী বলব
আরও একটুখানি হাসির কথা এই যে যেখানে মেয়েদের নামের শেষে ‘দাসী’ লিখতে বাধ্য করা হয় সেখানে ব্যথামিশ্রিত হাসির খোরাক আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বিধবাদের নামের শেষে লেখা হত ‘দাস্যা’৷ (বর্ণবিচিত্রা, ২য় পর্ব)
গণিকা ঃ গণক+ টা= গণিকা৷ ‘গণিকা’ শব্দের অর্থ হ’ল যে নারী রূপেগুণে, শিল্পে, কলায়, নৃত্যে, বাদ্যে , গীতে বা বৈবহারিক মাধুর্যে কিংবা অভিনয়ে এতই বেশী গুণসম্পন্না বা পারদর্শিনী যে তাকে সাধারণের ঊর্ধ্বে রাখতে হয়, গণ্যমান্য বলে ধরতে হয়৷ সুপ্রাচীনকালে এই সকল নারীকে বিবাহ করবার জন্যে পুরুষদের মধ্যে খুনোখুনি, রক্তারক্তি হয়ে যেত৷ তাই সামাজিক শান্তি রক্ষার জন্যে সেকালে সমাজের পুরোধারা রাজার কাছে আবেদন করে বলতেন, এই কন্যা রূপে–গুণে সাধারণের অনেক ঊর্ধ্বে৷ তাই রাষ্ট্র একে গণিকা বলে স্বীকৃতি দিক৷ রাষ্ট্র তখন সেই নারীকে অবিবাহিতা থাকতে অনুমতি দিত৷ যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় সংসারত্যাগিনী সন্ন্যাসিনী বাদে রাষ্ট্র আর কাউকে অবিবাহিতা থাকতে অনুমতি দিত না৷
দেবদাসীরাও সেকালে সমাজে গণিকা বলে গণ্য হ’ত, তাই তারাও অবিবাহিতা থাকবার অনুমতি পেত৷ সেকালে রাষ্ট্র ওই সকল গণিকাদের গ্রাসাচ্ছাদন ও নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব নিত৷ মোগল আমলের বাইজীরা নৃত্য–গীতে রত থাকায় কিছুটা সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেত ও অন্যান্য পতিতা নারীদের থেকে তারা পৃথক বলে গণ্য হ’ত৷ তবে মোগলযুগে বাইজীরা যে সম্মান পেত গণিকাদের সম্মান ছিল তার সহস্রগুণ বেশী৷ অন্য নারীরা যেখানে মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার পেত না, গণিকারা পেত৷ আমাদের ছোটবেলায় বর্দ্ধমান জেলার কোন কোন প্রাচীন মন্দিরে দেবদাসী থাকত৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা হ’ত ব্রাহ্মণ–কন্যা৷ তবে আজকাল আর কোথাও দেবদাসী আছে বলে শুনিনি৷
যাইহোক, গণিকা সম্বন্ধে ওই সকল ব্যবস্থা বৌদ্ধ যুগের শেষ পর্যন্ত ছিল৷ এরা সবাই যে পবিত্র জীবনে থাকত এমন কথা বলা যায় না৷ যারা পবিত্র জীবনে থাকত না তারা রাজাদেশ সাপেক্ষে বহুভর্ত্তৃকা হ’ত৷ বৌদ্ধোত্তর পৌরাণিক যুগে কেমন যেন একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে বৌদ্ধ–জৈন যুগে যা’ কিছুই সদর্থক ছিল তাকে উপেক্ষা করে এর বদলে বৌদ্ধ–জৈন যুগে সদর্থে ব্যবহূত অনেক সংস্কৃত শব্দ পৌরাণিক যুগে কদর্থে ব্যবহূত হতে লাগল৷ ‘গণিকা’ শব্দটি ওই রকম তার অর্থকৌলীন্য হারিয়ে ফেলে৷
‘‘বেদ শাস্ত্র পুরাণানি সামান্যা গণিকা ইব
একৈব শাম্ভবী মুদ্রা যুক্তাঃ কুলবধু ইব৷’’ (বৌদ্ধোত্তর যুগে রচিত যোগশাস্ত্র)
তাই বাংলাভাষায় তোমরা ‘গণিকা’ শব্দটি যতদূর সম্ভব ব্যবহার করো না৷ যে কদর্থে কেউ কেউ আজকাল ‘গণিকা’ শব্দ ব্যবহার করেন তার জন্যে সংস্কৃতে আরও অনেক শব্দই তো রয়েছে৷ (‘শব্দ –চয়নিকা’, ১৬শ পর্ব)