এই দশ লাখ বৎসরের মানুষের ইতিহাসে মানুষের প্রতি সুবিচার করা হয়নি৷ মানুষের একটি শ্রেণী, একটি বর্গের প্রতি বেশী বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, বেশী আদিখ্যেতা করা হয়েছে, ও তা, করতে গিয়ে অন্যকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে৷ একজন মানুষ লড়াই করল, মরল, আত্মদান দিল, কাগজে বড় করে তা ছেপে দেওয়া হ’ল, আর সে মরে যাওয়ার পর ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে নিয়ে তার বিধবা স্ত্রীকে কী ধরণের অসুবিধায় পড়তে হ’ল সেকথা খবরের কাগজে বড় করে ছাপানো হ’ল না অর্থাৎ একতরফা বিচার করে আসা হয়েছে৷ যদিও ব্যাকরণগত ব্যাপার, আর হঠাৎ বদলানো যায় না, তবু ‘ম্যান’ ‘man’ এই কমন জেণ্ডারের মধ্যে ‘ম্যান’, আর ‘ওম্যান’ •woman— দুই–ই এসে যায়৷ অথচ ‘ওম্যান’ এই কমন জেন্ডারের মধ্যে ‘ম্যান’ ও ‘ওম্যান’ দুই–ই আসবে না কেন? অর্থাৎ একতরফা, একপেশে বিচার করা হয়েছিল৷ ত্ত্ত্রু Man is a masculine gender, man is a common gender also—মানুষ বলতে পুংলিঙ্গও হ’ল, আবার উভলিঙ্গও হয়ে যাচ্ছে৷ মানুষ বলতে এখানে মেয়েমানুষও৷ তা’ এই ত্রুটিপূর্ণ জীবনের বোঝা নিয়ে দশ লাখ বছর ধরে মানুষ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এসেছে, সবাইকার প্রতি সুবিচার করেনি৷ তাই মানুষের সম্বন্ধে–মানুষ সম্বন্ধীয় ভাব নিয়ে এ্যাবষ্ট্রাক্ট নাউনে যে ‘মানবতা’ আর মানুষ সম্বন্ধে মানুষ–কৃত এই অর্থে ‘ষ্ণিক্’ প্রত্যয় করে ‘মানবিক’ শব্দের উত্তর এ্যাবষ্ট্রাক্ট নাউনে ‘তা’ যোগ করে যে ‘মানবিকতা’ এর প্রতি সুবিচার করা হয়নি৷ কিন্তু এই যে মর্যাদাভ্রষ্ট মানবতা, এই যে মর্যাদাভ্রষ্ট মানবিকতা (downtrodden humanity or downtrodden humanism)— এক নোতুন করে তাকিয়ে দেখবার সময় এসেছে৷
(‘‘নব্যমানবতাবাদী শেষ আশ্রয়’’ ‘বুদ্ধির মুক্তি–নব্যমানবতাবাদ’)
কিছুকাল আগেও কেউ কেউ বিধবা নারীর নামের সঙ্গে ‘শ্রীমতী’ বা ‘দেবী’ না লিখে ‘শ্রীমত্যা’ বা ‘দেব্যা’ লিখতেন৷ এরকম লেখা ব্যাকরণের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ তো বটেই, নারীর পক্ষে মর্যাদা হানিকরও৷ কারণ, বিধবা কী এমন অপরাধ করেছে যে জন্যে তাঁর শ্রীমতীত্ব বা দেবীত্বকে এই ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হবে বৈয়াকরণিক বিচারে ‘শ্রীমত্যা’ মানে ‘শ্রীমতীর দ্বারা’, ‘দেব্যা’ মানে ‘দেবীর দ্বারা’৷ অথবা–সধবা–বিধবা নির্বিশেষে সব নারীর নামের সঙ্গেই ‘শ্রীমতী’ বা ‘দেবী’ শব্দ ব্যবহূত হতে পারে৷ এতে কোন সামাজিক বাধাও নেই, আবার বৈয়াকরণিক আপত্তিও নেই৷ ইংরেজী ‘মিস’ (Miss) শব্দের অনুকরণে বাঙলায় অধবা মেয়েদের নামের আগে যে ‘কুমারী’ শব্দটি ব্যবহারের প্রথা প্রচলিত রয়েছে সেটি কোন প্রাচীন রীতি নয়৷ ব্রাহ্ম আন্দোলনের সময় বাঙলায় এটি প্রবর্ত্তন করা হয়৷
প্রাচীনকালে অধবা কায়স্থ মেয়েদের নামে পিতৃকুলের পদবীর সঙ্গে ‘দুহিতা’ শব্দ ও সধবা মেয়েদের নামে শ্বশুরকুলের পদবীর সঙ্গে ‘জায়া’ শব্দ ব্যবহার করা হত৷ যেমন, কোন অধবা নারীর নাম হয়তো ‘অনীতা’৷ ধরা যাক সে বসু পরিবারের কন্যা৷ সেক্ষেত্রে সে নিজের নাম বলত অনীতা বসুদুহিতা৷ আবার তার যদি বিবাহ হত কোন ঘোষ, মিত্র বা দত্ত পরিবারের, বিবাহের পরে সে নিজের নাম বলত অনীতা ঘোষজায়া বা অনীতা মিত্রজায়া৷ এটাও কিন্তু কোন সুনিশ্চিত পরিচয় নয়৷ কারণ, বিবাহের পরে ঘোষ পরিবারের স্ত্রী হয়ে যদি ঘোষজায়া হলেন বিবাহের পরেও কি তিনি বসু দুহিতা থেকে যাচ্ছেন না? কারণ, তিনি যে বসু পরিবারের কন্যা–এটা তো ঐতিহাসিক সত্য৷ বিবাহের পরেও তো তিনি বলতে পারেন, আমার নাম অনীতা বসুদুহিতা৷
কোন কোন জনগোষ্ঠীতে বিধবা মেয়ের নামের সঙ্গে ‘বেওয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ এটাও আপত্তিকর ব্যবস্থা ও নারীর পক্ষে সম্মানহানিকর৷ ‘বেওয়া’ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘বিধবা’ শব্দ থেকে৷ বিধবা ঞ্ছ বিবহা ঞ্ছ বেওয়া অবিধবা ঞ্ছ অবিহবা ঞ্ছ অইহওয়া ঞ্ছ আইহ ঞ্ছ এয়ো৷ বিবাহের স্ত্রী–আচারে অংশগ্রহণকারী নারীরা যেহেতু বিধবা নন, তাই কথ্য ভাষায় তাঁদের ‘এয়ো’ বলা হয়৷
সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে কোন্ নারী অধবা, কে সধবা, কেই বা বিধবা–এ জন্যে পার্থক্যসূচক শব্দের দরকারটাই বা কী? পুরুষের ক্ষেত্রে অকৃতদার, কৃতদার ও মৃতদার পুরুষের জন্যে পৃথক কোন সূচক চিহ্ণ তো ব্যবহার করা হয় না৷ তাই মেয়েদের এই ভাবে অধবা–সধবা–বিধবা পৃথকীকরণ পুরুষপ্রধান সমাজের একটি অবাঞ্ছিত ব্যবস্থা ছাড়া আর কী বলব
আরও একটুখানি হাসির কথা এই যে যেখানে মেয়েদের নামের শেষে ‘দাসী’ লিখতে বাধ্য করা হয় সেখানে ব্যথামিশ্রিত হাসির খোরাক আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বিধবাদের নামের শেষে লেখা হত ‘দাস্যা’৷
(বর্ণবিচিত্রা, ২য় পর্ব)