নীলকন্ঠ দিবসের প্রার্থনা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

পৌরাণিক গল্প অনুযায়ী অমৃতের সন্ধানে দেবতারা সুমুদ্র মন্থন করতে গিয়ে অমৃতের সাথে তীব্র হলাহল বিষতুলে আনে৷ যে বিষ সমগ্র পৃথিবীকে ধবংস করে দেবে৷ দেবতারা নিরুপায় হয়ে শিবের দারস্থ হয়৷ সদা মঙ্গলময় শিব সেই বিষ পান করে পৃথিবীকে রক্ষা করেন৷ পুরাণ অনুযায়ী শিব সেই বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়তে না দিয়ে কন্ঠে ধারণ করে রাখেন৷ বিষের প্রভাবে শিবের কন্ঠ নীল হয়ে যায়৷ সেই থেকে শিবের এক নাম হয় নীলকন্ঠ৷

পৌরাণিক এই গল্পটি শিক্ষামূলক৷ পুরাণের গল্পগুলির মধ্যে সত্যতা না থাকলেও লোক শিক্ষার বিষয়৷ পৃথিবীতে মন্দ ভালো দুই আছে৷ কবি বলেছেন---

‘বহু ভাগ্য সেই জন্মিয়াছি এমন বিশ্বে

নির্র্দেষ সে নয়,

মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব কে- না জানে

চিরকাল আছে সৃষ্টির বক্ষ মাঝে৷

তাই মানুষের জীবনটাই সংগ্রামমুখী৷ তাকে প্রতি মূহূর্তে অশুভের বিরুদ্ধে, মন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এগিয়ে চলতে হয়, কিন্তু পৃথিবীতে এক একটা সময় মন্দের প্রভাব, অশুভ শক্তির প্রভাব এতটাই বেড়ে যায়, অশুভ শক্তি জীবনের সর্বক্ষেত্রে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে, মানুষের পক্ষে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না৷ তখন স্বয়ং পরমপুরুষকে ধরাধামে অবতীর্ণ হতে হয় মানুষকে সেই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে৷ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন---

‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লাণির্ভবতি ভারত৷

অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌৷’

এখানে পৌরাণিক গল্পের হলাহল বিস সেই অশুভ শক্তির প্রতীক৷ আজ থেকে ৭০০০ হাজার বছর আগে পরমপুরুষ তারকব্রহ্মরূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন সদাশিব নামে৷ তিনি সেদিন আর্তমানবতার উদ্ধার করেন অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে সমাজ সংঘটনের মাধ্যমে, সঙ্গীত,কলা, চিকিৎসা যোগতন্ত্র জীবনের সর্ববিষয়ে মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়ে৷ ঠিক একইভাবে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল মানব সমাজ কে সেই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে৷

আজও মানব সমাজের সর্বক্ষেত্রে অশুভ শক্তিরপ্রভাবে মানুষের জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে৷ বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর পাপশক্তির করাল গ্রাসে মানুষের জীবন ও জীবিকা৷ মানুষকে এই পাপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করে শুভপথে, সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে ধর্মের পথে পরিচালিত করতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব ঘটে ১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমাতে৷ সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানবজীবনের জাগতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সর্বক্ষেত্রে আলোর দিশা দেখালেন৷ মানুষকে অভয় দিয়ে বললেন---‘হে মানুষ! ভীত হয়ো না, অন্ধকারের পর আলো আসবেই আসবে৷’’

পাপশক্তির কাছে অন্ধকারের জীবের চোখে আলো সহ্য হয় না৷ দিল্লিতে তখন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার৷ ১৯৭১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সিবিআই মিথ্যা মামলায় আনন্দমূর্ত্তিকে গ্রেপ্তার করে৷ বহু চেষ্টা করেও তাঁর বিরুদ্ধে আনিত মামলায় বিশ্বাসযোগ্য তথ্য যোগাড় করতে না পেরে আনন্দমূর্ত্তিজীকে জেলের মধ্যেই হত্যার চক্রান্ত করে সিবিআই৷ বিহারের বাঁকিপুুর সেন্ট্রাল জেলে ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী আনন্দমূর্ত্তিজীকে তীব্র বিষ প্রয়োগ করে সিবি আই ঔষধের সঙ্গে৷ কিন্তু সিবিআই-এর চক্রান্ত ব্যর্থ করে সেই বিষ হজম করে নেন আনন্দমূর্ত্তিজী৷ পাপশক্তির সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে৷ বিশ্বের সমস্ত আনন্দমার্গীদের কাছে বার্র্ত পাঠিয়ে দিলেন---‘আমি চাই তোমরা উত্তম শ্রেণীর মানুষ হও, তোমরা সর্বদাই্‌ লক্ষ্যের কথা চিন্তা করো৷ সব সময় নিজেদের আদর্শের দিকে লক্ষ্য রেখো৷ আর এই ভাবে আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের নীতিকে, নিজের আদর্শকে কঠোরভাবে মেনে চলো৷’’

১২ই ফেব্রুয়ারী বিশ্বের সমস্ত ভক্ত আনন্দমার্গীরা ‘নীলকন্ঠ’ দিবস পালন করেন৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি ওই দিন পাপশক্তিকে প্রতিহত করে আসুরী শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে তাদের প্রয়োগ করা তীব্র বিষ হজম করে শুভ শক্তির বিজয় কেতন উড়িয়ে ছিলেন৷ নীলকন্ঠ দিবসের প্রার্থনা হোক হে পরমপুরুষ---তুমি আমাদের আশীর্বাদ করো---আমরা যেন আমাদের মনকে আমাদের বুদ্ধিকে শুভপথে পরিচালিত করতে পারি৷