‘‘নির্ভয়ে ছুটিতে হবে সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা’’

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

প্রতি ২৫শে বৈশাখ আমরা মহাসমারোহে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করি৷ কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শকে বোঝবার চেষ্টা করি কি? মনে হয়, এ ব্যাপারে আমরা ততটা উৎসাহী নই৷ কিন্তু এই জীবনাদর্শই তো সবেলচয়ে বড় কথা এই জীবনাদর্শই তো তাঁকে সমস্ত কাজে প্রেরণা জুগিয়েছিল৷...... আসুন আজ তাঁর একটি কবিতার আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শকে বুঝতে চেষ্টা করি৷

আলোচ্য কবিতাটির নাম ‘এবার ফিরাও মোরে৷’ আমার মনে হয় এই কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের অন্তরসত্তা ও তার মর্মবাণী৷ রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাব্য–সাহিত্য কর্মধারার এইটাই মর্মকথা৷

কবিতাটির নাম ‘এবার ফিরাও মোরে৷’ রবীন্দ্রনাথ একজন কবি৷ সাধারণতঃ সমস্যা–সংকূল সংসারের ঊর্ধ্বে এক আনন্দলোকের মধ্যে বিচরণ করাই কবিমনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য৷ তাই কবির কবিতার শুরুতে রয়েছে কবির স্বগতোক্তি৷ কবি নিজেকে বলছেন–

‘‘সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত

তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো

মধ্যাহ্ণে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে

দূর বন গন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে

সারাদিন বাজাইলি বাঁশি৷’’

কবি মনের হয়ত এটাই স্বভাব৷ কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের অন্তরসত্তা এভাবে বাস্তব পৃথিবী থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছে না৷ বাস্তব দুনিয়ার অন্যায়–ত্যাচার–শোষ কবিমনকে অস্থির করে তুলেছে৷তাই তিনি নিজেকে আবার বলছেন,

                ‘‘ওরে তুই ওঠ আজি৷

আগুন লেগেছে কোথা কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি

জাগাতে জগজ্জনে৷ কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে

শূন্যতল কোন্ অন্ধ কারা মাঝে জর্জর বন্ধনে

অনাথিনী মাগিছে সহায়৷ স্ফীতকায় অপমান

অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান

লক্ষ মুখ দিয়া৷’’

অত্যাচারিত মানুষ–শোষিত মানুষ মূক হয়ে গেছে৷ এই অত্যাচারকে বিধিলিপি মেনে নিয়েই তারা নিজেদের অদৃষ্টকেই দোষ দিচ্ছে, এই অত্যাচারের যে কোনো প্রতিকার হতে পারে–এ চিন্তাটুকুও তারা করতে পারছে না৷ তারা ভাবছে, এই গর্বোদ্ধত অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে কোনদিন সম্ভব নয়৷ এটা তাদের জীবনভোর মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই৷

এই অবস্থায় লাঞ্ছিত নিপীড়িতদের উদ্দেশ্যে কবি হূদয় থেকে উৎসারিত হচ্ছে এক বলিষ্ঠ অভয়বাণী ঃ

‘‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে

আর ভয়ে ভীত তুমি সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে

যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে,

যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তোমার তখনই সে

পথ কুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে৷

দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার

মুখে কারে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার

মনে মনে৷’’

কবি রবীন্দ্রনাথ একজন ভাববিলাসী কবি নন৷ তিনি তাঁর সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করছেন–

‘‘বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা–সম্মুখেতে কষ্টের সংসার

বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার৷

অন্ন চাই, প্রাণ চাই,

আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,

চাই বল, চাই স্বাস্থ্য,

আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,

সাহস বিস্তৃত বক্ষপট৷’’

কিন্তু এই অবস্থায় এই নিঃস্ব, রিক্ত, দরিদ্র, লাঞ্ছিত মানুষের জন্যে কবির কী করণীয়? কবি নিজের অন্তরাত্মাকে আবার এই কথাই জিজ্ঞেস করছেন৷

আর এর উত্তরেই কবির অন্তর থেকে যে বলিষ্ঠ সত্যের বাণী ফুটে বেরিয়ে আসছে–সেই বাণী শাশ্বত সত্যের বাণী–এটাই বিশ্বজনের উদ্দ্যেশ্যে ঋষি–কবি রবীন্দ্রনাথের অন্তরের গভীর উপলব্ধি–প্রসূত বাণী ঃ

‘‘বলো, মিথ্যা আপনার সুখ,

মিথ্যা আপনার দুঃখ৷ স্বার্থমগ্ণ যেজন বিমুখ

বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’

এতটা বললেই বোঝা যায় এ এক বলিষ্ঠ মানবতাবাদীর কথা৷ আজকে বিশ্বের কেউই কবির এই মানবতাবাদের দিকটা অস্বীকার করেননি৷ এই আসল সত্যটা হচ্ছে, কবি এখানেই থেমে থাকেন নি৷ এই সুগভীর মানবতাবোধের উৎসটা কী? তা না জানলে তো  ‘মানবতাবাদ’ কেবল বাগাড়ম্বর পূর্ণ বত্তৃণতার ফুলঝুরি হয়ে থাকবে৷ পৃথিবীর রুক্ষ নিষ্ক্রুণ মৃত্তিকায় তা কোনো ফসল ফলতে পারবে না৷

কবি তাঁর আন্তর উপলব্ধির গভীরতা থেকে এই মানবতাবোধের উৎসের সন্ধান পেয়েছেন–যে উৎসকে বাদ দিলে মানবতাবাদ কেবল ফাঁকা বুলিই থেকে থাকবে৷ রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির এই গভীরতাকেই বুঝতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথ যখনই বলছেন ‘‘স্বার্থমগ্ণ যে জন বিমুখ / বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’ ঠিক এর পরের লাইনেই বলছেন–

‘‘মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে

নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা৷

মৃত্যুরে না করি শঙ্কা৷ দুর্দিনের অশ্রুজলধারা

মস্তকে পড়িবে ঝরি, তারি মাঝে যাব অভিসারে

তার কাছে–জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে

জন্ম জন্ম ধরি৷’’

‘সত্যে’র প্রকৃত অর্থ হ’ল অপরিণামী সত্তা অর্থাৎ পরমেশ্বর–পরমপুরুষ৷ পরমপুরুষ সর্বভূতত্মা–সর্বজীবেই তাঁর অবস্থান৷ তাই মানুষের মনে যখন পরমপুরুষের প্রতি ঐকান্তিক প্রেম–আকর্ষণ জাগবে–তখন সে জগতের সমস্ত মানুষকে ভালবাসবে কারণ–

‘‘সবায় নিয়ে সবার মাঝে

লুকিয়ে আছ তুমি

সেই তো আমার তুমি৷’’

রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাব্য–সাহিত্যের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের কথা রয়েছে৷