আগস্ট , ২০১০৷ হায়দ্রাবাদ শহরে অনুষ্ঠিত হয় গণিতজ্ঞদের বিশ্বসম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথমেটিশিয়ানস ৷ চার বছর অন্তর আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তিন বা চার জন নবীন গণিতজ্ঞের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেরার শিরোপা৷ ফিল্ডস মেডেল - ‘গণিতের নোবেল’৷ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের সেরা গণিতজ্ঞরা ৷ ন’দিন ব্যাপী সম্মেলনে সকলের নজর পড়ে এক গেরুয়াবসন সন্ন্যাসীর উপর৷ নাম ? স্বামী বিদ্যানাথানন্দ৷ কিন্তু এক সন্ন্যাসী কেন উপস্থিত গণিতজ্ঞদের বিশ্বসম্মেলনে ? কি তাঁর আসল পরিচয় ? উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েকটা বছর৷
মহান মিত্র ৷ জন্ম ১৯৬৮ সালে কলকাতাতেই৷ ক্লাস টেন এবং টুয়েলভ সেন্ট জেভিয়ার্সে ৷ ছোট থেকেই ধ্যানজ্ঞান একটাই - অঙ্ক ৷ পড়া শেষ বহু গণিতজ্ঞের জীবনী৷ আইআইটি এন্ট্রান্স র্যাংক ৬৭৷ ভর্তি হলেন আইআইটি কানপুরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে৷ থার্ড সেমেস্টারে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং অসহ্য মনে হল মহানের৷ বুঝতে পারলেন তাঁর পছন্দের বিষয় অঙ্ক-র জায়গা খুবই কম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে৷ বিদ্রোহ করলেন মহান৷ বাড়িতে জানালেন, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়েছুড়ে কানপুর আইআইটি-তেই গণিত নিয়ে পড়তে চান৷ বাড়িতে সবার মাথায় হাত৷ মহান নাছোড়৷ বহাল রইল তাঁর জেদ৷ বিষয় বদল করলেন মহান৷ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে যোগ দিলেন আইআইটি কানপুরে গণিত বিভাগে৷ ১৯৯২৷ কানপুর আইআইটি থেকে গণিতে এমএসসি৷ দুর্দান্ত রেসাল্ট৷ পিএইচ ডি করতে পাড়ি দিলেন বার্কলে শহরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ বিষয় জ্যামিতি৷ ১৯৯৭ সালে পিএইচ ডি৷ বিষয় জ্যামিতি৷
বিদেশবাসকালে জীবনের আর এক সিদ্ধান্ত৷ আসলে ডাকটা মনের মধ্যে ছিল আইআইটি-তে ছাত্রাবস্থাতেই৷ আহ্বান আধ্যাত্মিকতার৷ স্বামী বিবেকানন্দের৷ সন্ন্যাস জীবনের৷ দেশে ফেরার পর মাত্র কয়েক মাস চেন্নাইয়ের ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিকাল সায়েন্সেস-এ৷ ১৯৯৮ সালে মহান যোগ দিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে৷ ২০০৮-এ পুরোদস্তুর গেরুয়াবসন সন্ন্যাসী৷ স্বামী বিদ্যানাথানন্দ৷ মহান মহারাজ৷ পরিবারের সায় ছিল না৷ মিশন দুই শিক্ষা দেয়৷ সেবা এবং সন্ধান৷ সেবা হল পড়ানো৷ জ্যামিতির জ্ঞান ছাত্রদের বিলিয়ে দেওয়া৷ আর সন্ধান? তা আত্মিক প্রচেষ্টা৷ ক্রমাগত সত্যের খোঁজ৷ গভীরে, আরও গভীরে৷ বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সাল অবধি অধ্যাপনা করেছেন মহান মহারাজ৷ বর্তমানের ঠিকানা মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ৷
মহানের সত্যসন্ধান গণিতের যে শাখায়, যেখানে বীজগণিত হাত ধরেছে টপোলজি-র৷ বীজগণিত নিজে হজম করেছে পাটিগণিত৷ মাইনাস ১-এর বর্গমূল কত, তা পাটিগণিত বলতে পারে না৷ সে ব্যর্থতার তোয়াক্কা না করে বীজগণিত এগিয়ে যায় অনেক দূর৷ আবিষ্কার করে নতুন ভুবন৷ আর টপোলজি? তাকে এক কথায় বলে ‘রাবারশিট জিয়োমেট্রি’৷ মানে, রবারের চাদরে আঁকা নকশা৷ চাদরটাকে বাঁকালে বা মোচড়ালে নকশার চেহারা বদলায়, চরিত্র নয়৷ আসলে, টপোলজি হল জ্যামিতির সেই উন্নত রূপ, যা থেমে থাকে না মাত্র তিন মাত্রায় (ডান-বাম, উপর-নীচ, সামনে-পেছনে), কাজ করে পছন্দমত অনেক মাত্রা নিয়ে৷ সে সব মাত্রায় বিন্দু রেখা ত্রিভুজ বা বহুভুজ ধারণ করে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর আকৃতি৷ এমন সব আকার, যা কেবল বিরাজ করে মনের আকাশে৷
প্রয়াত মার্কিন গণিতজ্ঞ উইলিয়াম থার্সটন চার দশক আগে পেশ করেছিলেন এক অনুমান: ‘থার্সটন জিয়োমেট্রাইজেশন কনজেকচার’৷ সে অনুমান অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন মহান৷ দেখিয়েছেন, তা প্রয়োগ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে৷ মহানের সাফল্যকে বিশ্ববরেণ্য গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস বরাদান বলেছেন ‘ইম্পর্ট্যান্ট মাইলস্টোন’৷ কৃতিত্বের জন্য মহান ২০১১ সালে পেয়েছেন শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার৷ ভারতে বিজ্ঞানের সেরা শিরোপা৷ ২০১৫ সালে ইনফোসিস প্রাইজ৷ অর্থমূল্য ৬৫ লক্ষ টাকা৷ সে অর্থ মহান দান করেছেন ত্রিবেণী ট্রাস্টকে৷ যে ট্রাস্ট গড়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন৷ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর সংগ্রহে বহু প্রাইজের অর্থ (বেশ কয়েক কোটি টাকা) ঢেলে৷ ট্রাস্টের উদ্দেশ্য? হিতকর শিক্ষাপ্রসারে অনুদান৷
যে ভারত একদা ছিল গণিতচর্চার পীঠস্থান, যার উর্বর ভূমিতে জন্মেছিল শূন্য বা ‘জিরো’-র মতো যুগান্তকারী ধারণা, সে দেশ গণিতশাস্ত্রকে একবিংশ শতাব্দীতে উপহার দিয়েছে এক জন স্টার৷ মহান মহারাজ৷ কুর্নিশ৷ (সংগৃহীত)