সংবাদদাতা
পত্রিকা প্রতিনিদধি
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্ত হয়৷ এরপর ভারতের রাষ্ট্রনীতি কী হবে, কীভাবে আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা চলবে তা নির্ধারণের জন্যে ডঃ বি.আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে এক কমিটি তৈরী করা হয়, তার ওপর ভারতের সংবিধান লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ সংবিধান হল সেই নির্দেশক পুস্তক যাতে রাষ্টের আচরণ বিধি, আইন ও আদর্শ লিপিবদ্ধ থাকবে৷ যথারীতি ওই কমিটি তাদের লিখিত সংবিধান তৈরী করে ও ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়৷ এই সংবিধানে দেশের প্রতিটি মানুষের জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের অধিকার স্বীকৃত আছে৷ দেশের প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার, স্বাধীনতার অধিকারও মেনে নেওয়া হয়েছে৷ প্রতিটি মানুষের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকারও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷ সংবিধানের নীতি ও আদর্শ তো আপাতত শুনতে খুবই ভাল৷ কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ হচ্ছে কী? এইটেই মূল প্রশ্ণ৷
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশ বর্তমানে ভারতে আর্থিক বৈষম্য ব্রিটিশ আমলের থেকেও বেশী৷ ওই প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে---দেশে ধনকুবেরদের রাজ চলছে৷ দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ গ্রাস করে নিয়েছে মুষ্টিমেয় ধনকুবেররা৷ সাধারণ মানুষের অর্থাৎ নীচের দিকের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৭১ হাজার টাকা সেখানে সব থেকে ধনী দশ হাজার ব্যষ্টির গড় আয় বছরে ৪৮ কোটি টাকা৷
বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদনে প্রকাশ ভারতে ১৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে৷ বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ভারতের স্থান প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকেও অনেক নীচে৷ সাধারণ মানুষের আয় কমলেও বেকারত্ব বাড়লেও ধনকুবেরদের আয় কয়েক গুণ করে বেড়েছে৷
এরই নাম কি সমানাধিকার? একদিকে অনাহারে মৃত্যুর মিছিল অন্যদিকে বিপুল সম্পত্তি বৃদ্ধি৷ সংবিধানের আপাতমধুর প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে এদেশের রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রনেত্রীবর্গ পুঁজিপতিদের তোষণ করেছেন ও সাধারণ গরীব মানুষদের প্রতি শোষণও অবাধে হয়ে যেতে দিয়েছেন৷ সে শোষণ বন্ধ করার চেষ্টা তো করেননি, বরং সেই শোষণ আরও বেশি করে যাতে চলে তারই ব্যবস্থা করেছেন৷
কেন এমনটা হচ্ছে? এর মূল কারণ হল ভারতের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে , এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের তাড়ানোর মূল লক্ষ্য ছিল৷ কিন্তু জনগণের অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির কোন আদর্শ নেতাদের সামনে ছিল না৷ যদিও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও এম.এন রায় এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন৷ কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরকরণ যাদের হাতে হয়েছিল তারা কেউ এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেননি৷ ফলে স্বাধীনতা লাভের ফলে দেশে যে নোতুন সরকার তৈরীর হয়েছে তার মূল নিয়ন্ত্রণ ভার যাদের হাতে থেকেছে তারা আর কেউ নয় সেই দেশীয় পুঁজিপতি গোষ্ঠী৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরক্ষে বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীও৷ দেশের নেতা নেত্রীরা পুতুল নাচের মতো জনসমক্ষে অভিনয় করে গেছেন কিন্তু তারা এক অদৃশ্য সুতোর দ্বারা পুঁজিপতিদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন৷ নির্বাচনী বণ্ড সামনে আশায় বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়েছে৷ কারণ পুঁজিপতিরা বিনাস্বার্থে অর্থ বিনিয়োগ করে না৷ আর বলাবাহুল্য শুধু ভারতকে নয়, সারা বিশ্বের পুঁজিপতিরা এক সূত্রেই গাঁথা ছিল৷ অর্থনৈতিক মূল নীতি হিসাবে ‘অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ’ নীতি সব দেশেই অব্যাহত থাকল৷ যে সমস্ত দেশ কমুউনিষ্ট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল বা নোতুন করে কমিউনিষ্ট শাসন কায়েম হলো (যেমন চিনে) সে সমস্ত দেশেও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ নীতি অব্যাহত রইল বা চালু হল৷ তাই কমিউনিষ্ট দেশগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক পুঁজিবাদী নীতিই অনুসরণ করতে থাকল৷
অকম্যুনিষ্ট দেশগুলিতে যেমন দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি গোষ্ঠী. কম্যুনিষ্ট দেশগুলিতে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল শাসন ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক পার্টির নেতা নেত্রীরা৷ জনগণের হাতে অর্থনৈতিক শক্তি বন্টিত হ’ল না৷ ফলে জনগণের শৃঙ্খল মুক্তি ঘটল না৷
তাছাড়া, ব্লকভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথাও স্বাধীনতার পর কেউ ভাবল না৷ কেন্দ্রের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশেষ বিশেষ নেতা-নেত্রী পার্টি বা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করাটাই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঞ্চালিকা শক্তি থেকে গেল৷ আর বলা বাহুল্য, তারও গোড়ায় থেকে গেল মুনাফালুন্ঠন নীতি৷ প্রফিট মোটিব্৷ কনজামসন মোটিব্ নয়৷ ফলে দেশের সমস্ত জেলায় সমস্ত ব্লকে কৃষিশিল্পের উন্নতি ঘটানোর নীতি গৃহীত হ’ল না৷ আর তা না করার জন্যে দেশের কোনো কোনো এলাকা ‘ঘাটতি শ্রম’ এলাকা থেকে গেল, কোনো কোনো এলাকা ‘উদ্বৃত্ত শ্রম’ এলাকা থেকে গেল৷ ফলে বেকার সমস্যাটাও জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকল৷ চাকরীর জন্যে সর্বত্র যুবক ছেলে মেয়েরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল৷ গত বছর করোনা লক্ডাউনের আবহে ‘পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা’ নামক যে জটিল সমস্যা দেখা দিল তার উৎস কিন্তু ভারতের এই ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নীতি দেশে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা নীতি গৃহীত থাকলে এই ধরণের সমস্যার উদ্ভব হ’ত না৷ প্রতিটি ব্লকে ওই ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা নীতি গৃহীত থাকলে এই ধরণের সমস্যার উদ্ভব হ’ত না৷ প্রতিটি ব্লকে ওই ব্লকের বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হ’ত৷ ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়েছে, এদেশে সংবিধান ও আইনের চোখে কোনো জাত -পাত সম্প্রদায়ের বিভেদ দেখা হবে না৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সর্বত্র জাত-পাত-সম্প্রদায় নিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বের আবহ৷ ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, সকল মানুষের সম অধিকার’ ---এটা যুগের নীতি৷ কিন্তু ভারতের সংবিধানের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আজ সর্বত্র সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের কুচকাওয়াজ শুরু হয়ে গেছে৷ এর পরিণতি যে অতি ভয়ঙ্কর তা অনুমান করতে মোটেই অসুবিধা হয় না৷আজ দেশের তথা বিশ্বের সামনে এই যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ এক ভয়ঙ্কর বিষ্ফোরণ সামনে অপেক্ষা করছে৷ এর থেকে বাঁচবার একমাত্র রাস্তা মহান্ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘প্রাউট’ প্রবর্তিত ‘নোতুন নীতি’ নোতুন নেতা’ তত্ত্ব--- প্রাউটের প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ও ‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’র নোতুন নীতি৷ দেশের বিদগ্দজনকে তথা ছাত্রও যুব সমাজকে তাই এই সংকট মূহূর্তে ‘প্রাউটে’র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷