পাঞ্চজন্য

লেখক
শ্রীসুভাষ প্রকাশ পাল

ভুত্তিপ্রধান থাকাকালীন বিভিন্ন প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই কোলকাতা যেতে হত এবং কাজের চাপ থাকলে তিলজলা আনন্দমার্গ আশ্রমে রাত্রিবাসও করতে হত, একবার তিলজলা গিয়েছি, রাত্রিতে কাশীশ্বরানন্দদার রুমে থাকার ব্যবস্থা হল, ভোরবেলা প্রাতঃকৃত্য সেরে সকালের হাওড়াগামী প্রথম এস২৪ বাস ধরব বলে প্রস্তুতি নিয়ে দাদার কাছে গিয়েছি বিদায় নেওয়ার জন্য৷ দাদা বললেন পাঞ্চজন্য করে তারপর যাবে৷ আমি বললাম---দাদা ফার্স্ট বাস না পেলে আমার সুকলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে, খুব অসুবিধায় পড়ে যাব, দাদা বললেন---পাঞ্চজন্য করে যাও৷ সব কাজই সুষ্ঠুভাবে হবে, দাদার আদেশ বা পরামর্শ কখনও অমান্য করিনি, অগত্যা পাঞ্চজন্য করে আর কারও সাথে বাক্যালাপ না করে সঙ্গে সঙ্গে রবানা দিলাম বাস ধরার জন্য৷ আমি বাসস্টান্ডে পৌঁছেছি দেখলাম৷ ---আমার জন্য নির্দিষ্ট বাসটি সেই সময় স্ট্যাণ্ডে ঢুকল৷ সঙ্গে  সঙ্গে বাসে উঠলাম৷ সারাদিনের কর্মসূচী সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল, এভাবে আরও কয়েকবার অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে আমি পাঞ্চজন্য না করেই বেরিয়ে আসব তিলজলা থেকে দাদা ছাড়বেন না প্রতিবারেই দেখেছি--- কখনও খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়নি৷ দাদা একদিন বলেছিলেন---যারা পাঞ্চজন্য নিয়মিত করে, াা তাদের সব ব্যাপারে সর্বদা সহায়তা করেন৷ গুরু বলেছেন--- মার্গীদের ভোর পাঁচটায় পাঞ্চজন্য করতে হবে৷  গুরুবাক্য পালন করলে গুরু সন্তুষ্ট হন৷ গুরু সন্তুষ্ট হলে সাধকের সবকিছু  পাওয়া হয়ে যায়৷ প্রকৃত ঘটনা হল---আগে পাঞ্চজন্য করতাম তা নিয়মিত নয়৷ কোনদিন ঘুম ভেঙ্গেছে কোনদিন যথাসময়ে ঘুম ভাঙেনি, কিন্তু দাদার মধুর শাসনে এখন নিয়মিত পাঞ্চজন্য করি৷

যাঁরা মার্গের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা ভাবছেন পাঞ্চজন্য আবার কী জিনিষ? অনেকে মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের কথা শুনেছেন৷ শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খের নাম পাঞ্চজন্য, শ্রীকৃষ্ণ এই পাঞ্চজন্য শঙ্খবাজিয়ে কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গণে কুরুপাণ্ডবের মহাযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন৷ পৃথিবীতে সৎ ব্যষ্টিদের রক্ষা করার জন্য, পাপীদের বিনাশ করা জন্য এবং অধর্মের গ্লানি থেকে সমাজকে রক্ষা করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল৷ তিনি এই পাঞ্চজন্য বাজিয়েই ধর্মযুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন৷ ঠিক সেই রকমভাবে আমাদের পাঞ্চজন্যও একটি দিনের শুভসূচনা, আচার্য বিবেকানন্দ অবধূত এবং আচার্য পীযূষানন্দ অবধূত ‘আনন্দমার্গ’---এক সুসন্তুলিত জীবনচর্যা’ বইটিতে খুব সুন্দরভাবে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন--- ‘‘প্রভাতের আলো যেমন রাত্রির সকল অন্ধকারকে দূর করে জীবনে আনন্দের বার্র্ত আনে, তেমনি উষাকালে কীর্ত্তন দিয়ে চারিদিকের অনুভক্তির অন্ধকারকে দূর করে এক নোতুন দিনের শুভ উদ্বোধন করা এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য,পাপশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির এই যুদ্ধ ঘোষনা এ যুগের নব পাঞ্চজন্য৷

ভোর পাঁচটায় (স্থানীয় সময়) সাধকেরা সমবেত ভাবে স্থানীয় জাগৃতিতে বা নির্দিষ্ট কোনস্থানে মিলিত হয়ে ৫মিনিট প্রভাত সঙ্গীত, ১৫ মিনিট কীর্তন  ও অন্ততঃ ১০মিনিট ঈশ্বর প্রণিধান করবেন৷ শুধু রবিবার ১০মিনিট প্রভাত সঙ্গীত করতে হবে আর কীর্ত্তন ও ঈশ্বর প্রণিধানের সময় একই থাকবে৷’’

পাঞ্চজন্য নির্দিষ্ট সময়েই শুরু করতে হয় অর্থাৎ ভোর ৫টা৷ গ্রীষ্ম বা বর্ষায় এই পাঞ্চজন্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সবারই খুব বেশী অসুবিধা হয় না৷ সমস্যাটা হয় শীতকালে, বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশের মার্গীদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হত, একবার ইয়ূরোপের মার্গীরা তৎকালীন ধর্মপ্রচার সেক্রেটারী (ডিপিএস) আচার্য তপেশ্বরানন্দ অবধূতকে অনুরোধ জানালেন---তিনি যেন াাকে বলে পাঞ্চজন্যের সময় টা একটু পিছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন৷ তাঁদের পীড়াপিড়িতে দাদা একদিন সময় করে াাকে মার্গীদের পাঞ্চজন্য বিষয়ে অনুরোধের কথাটা জানালেন, াা প্রস্তাব শুনেই রেগে অগ্ণিশর্মা, পরে কিছুটা শান্ত হয়ে জানালেন---

বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি মার্গীদের জন্য এই পাঞ্চজন্যের ব্যবস্থা দিয়েছেন৷ তপেশ্বরানন্দদা তাঁর াার সঙ্গে দিনগুলি পুস্তকে খুব সুন্দরভাবে বিষয়টির বর্ণনা দিয়েছেন---‘‘াা বললেন--- প্রত্যেক  সাধকেরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা দরকার, আর  তা হল সূর্র্যেদয়ের ৪৫ মিনিট পূর্বে, সেই সময় সূর্য থেকে এক বিশেষ তরঙ্গ উৎসারিত হয় যা সাধকের  পক্ষে হিতকর, আর সেই তরঙ্গের মাধ্যমে তিনি সমস্ত ঋণাত্মক ভাবনা সাধকমন থেকে সরিয়ে দিয়ে ধনাত্মক ভাবনায় তাকে আপ্লুত করে দেন৷ তাই পাঞ্চজন্যকে তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার  অঙ্গ হিসেবে একটা বিধিবদ্ধরূপ দিয়েছেন, সেইজন্য সমস্ত সাধকেরই উচিত ঠিক পাঁচটার সময়ই পাঞ্চজন্য শুরু করা াা আরও জানালেন যে তিনি সঙ্কল্প নিয়েছেন---যারা বিধিবদ্ধরূপে নিয়মিত পাঞ্চজন্য করবে, তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির দায়িত্ব তিনি নিজে নেবেন, াার কথায় মানুষের  আবেগও সমস্যা ও মানসিক সমস্যাসহ আরও অনেক ব্যধি পাঞ্চজন্যের মাধ্যমে সেরে যেতে পারে৷ যেহেতু গুরু চান যে সবাই পাঞ্চজন্য করুক, এটা তাঁর সঙ্কল্প, তাই সকলেরই এটা অবশ্য করা উচিত৷

যাঁরা স্বভাবগতভাবে অলস,চেষ্টা সত্ত্বেও আলস্যতাকে জয় করতে পারছেন না, তাঁরা যদি নিয়মিত পাঞ্চজন্য ও তাণ্ডব নৃত্যের অভ্যাস করেন, তবে খুব শীঘ্রই তাঁরা আলস্যরূপী মহাশত্রুকে জয় করতে পারবেন৷

াা সাধকের মঙ্গলের জন্য এই পাঞ্চজন্যবিধি প্রদান করেছেন, যাঁরা নিজেদের উন্নতি কামনা করেন, তাঁরা অবশ্যই যত কষ্ট হোক পাঞ্চজন্য বিধি মেনে চলবেন৷