১৯৮২ সালের সেপ্ঢেম্বর মাস৷ আনন্দমার্গ সংঘটনের প্রাণ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী কিছুদিন দেওঘর আনন্দমার্গ আশ্রমে অবস্থান করছেন৷ ১৪ই সেপ্ঢেম্বর থেকে গান দিতে শুরু করেছেন, যা প্রভাত সঙ্গীত নামে পরিচিতি লাভ করেছে৷ গান রচনা করেছেন বললাম না৷ কেননা তাঁর দেওয়া ৫০১৮টি গানের কোন ভাব আসতে তিনি গুন গুন করে গাইতেন আর তাঁর পাশে যারা সর্বক্ষণের কর্মীরা তা লিখে নিতেন, সুরটা মনে রাখতে হত, পরে গুরুদেবকে তা শুনিয়ে প্রয়োজনে ভুল শুধরে নিয়ে সেগুলির স্বরলিপি তৈরী করা হত৷ ওই সময় কোলকাতা থেকে প্রতিদিনই কোন না কোন মার্গী বা সন্ন্যাসীকে গুরুদেবের কাছে যেতে হত৷ সঙ্গে নিয়ে যেতে হত গুরুর জন্য আনন্দনগর থেকে আনীত বিশুদ্ধ পানীয় জল, ডাব, মিষ্টান্ন, গাছ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে, ওই সময় আমার আচার্যদেব তথা সেই সময়কার আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের ধর্মপ্রচার সচিব আচার্য তপেশ্বরানন্দ অবধূতের সৌজন্যে আমারও গুরুদর্শনের সুযোগ ত্বরান্বিত হল, আমি একদিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দেওঘর আনন্দমার্গ আশ্রমে সংঘের প্রতিনিধিরূপে উপস্থিত হলাম,দেওঘর আনন্দমার্গ আশ্রমে আমার প্রথম আগমন, ওখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও মনোরম পবিত্র পরিবেশ এখনও মনের স্মৃতিকোঠায় জ্বল জ্বল করছে ভেসে ওঠে৷ সন্ধ্যায় আশ্রমের মধ্যেই ৰাৰার কাছাকাছি থেকে উদ্যান পরিক্রমণ ছিল পরমানন্দস্বরূপ, এত কাছে থেকে বাবাকে (আনন্দমার্গীরা তাঁদের গুরুদেবকে ‘ৰাৰা’ বলেই সম্বোধন করেন) দর্শন ও তাঁর মুখনিসৃত বাণী শ্রবণ এর আগে কখনও হয়নি৷ একটা আবেশের মধ্যেই প্রতিটি মুহূর্তে অতিক্রান্ত হয়েছে৷ রাত্রির আহার সেরে যথাসময়েই নিদ্রামগ্ণ হলাম৷ ভোরবেলা সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে একজন সন্ন্যাসিনী দিদির (জ্যোতিদি) কন্ঠস্বর শুণতে পেলাম তিনি চিৎকার করে বলছেন ---পাঁশকুড়া থেকে কোন মার্গীভাই এসেছেন? আমি পরিচয় দিতেই তিনি জানালেন--- ৰাৰা গতকাল খোঁজ নিচ্ছিলেন--- পাঁশকুড়ায় মহিলা-পরিচালিত কোন স্কুল হয়েছে কি না ৰাৰা যখন বলেছেন, তখন মহিলা পরিচালিত স্কুল করতেই হবে৷ একটা বিষয় লক্ষনীয়---আনন্দমার্গের শিক্ষাবিধি অনুসারে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলে এবং মেয়ে একসঙ্গে পড়াশুনা করবে তবে পুরুষ পরিচালিত স্কুলে শুধু পুরুষ শিক্ষক এবং মহিলা পরিচালিত স্কুলে শুধু মহিলা শিক্ষিকা থাকবেন৷ আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল--- আমি যেন পাঁশকুড়ায় ফিরে গিয়ে একটি মহিলা পরিচালিত স্কুল তৈরীর ব্যাপার উদ্যোগ নিই৷ ইতিপূর্বে ১৯৮২ সালে বাকুল্দায় একটি পুরুষ পরিচালিত স্কুল হয়েছে সৌভাগ্যক্রমে ঐদিন সকালে ৰাৰার সঙ্গে একই গাড়িতে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ হল৷ ৰাৰা ঐদিন ৬নং প্রভাত সঙ্গীত দিয়েছেন, গানটি হল---
‘বন্ধু আমার
বন্ধু আমার
সোনার আলোয় ঢাকা
ভোরের পাখী
উঠলো ডাকি
প্রাণের পরাগ মাখা৷
কিসের তরে
কিসের ডাকে
দিনে রাতে খুঁজি তাকে
নোতুন আলোর ঝলকানি দেয়
দোলায় নোতুন পাখা৷
বেড়াতে যাওয়ার সময় গাড়ীতে বাবা ঐ গানটিকে অর্থ সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে ছিলেন, সন্ধ্যার ট্রেনেই পাঁশকুড়া রবানা হলাম, ফিরে এসে পাঁশকুড়ার মার্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম৷ শ্রীপতিতপাবন মাইতি, শ্রীসুকুমার সাউ, শ্রীবনমালি মণ্ডল প্রমুখ মার্গীরা অগ্রণী ভূমিকা নিলেন৷ স্কুলের পঠন পাঠনের জন্য একটা ভাড়া বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না? ময়না এলাকা থেকে বহু মানুষ ব্যবসা-বানিজ্য করার জন্য পাঁশকুড়া স্টেশন এলাকায় জায়গা কিনেছেন ও ঘরবাড়ি বানিয়েছেন৷ একদিন সুকুমার সাউ আমি সাইকেলে চড়েই ময়না রবানা হলাম সম্ভাব্য বাড়ির মালিকের সন্ধানে৷
এক পরিচিত ভদ্রলোকের বাড়িতে উঠলাম, এতদূর থেকে সাইকেল চালিয়ে গিয়েছি দেখে তিনি বিস্মিত হলেন৷ অতিথি আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখলেন না৷ ওখানেই সারতে হলো৷ স্কুল সম্পর্কিত নানা কথা হলো, কিন্তু ব্যবসায়ী ভদ্রলোক নানা অজুহাত দেখিয়ে স্কুল করার জন্য বাড়ি ভাড়া দিতে অপারগ বলে জানিয়ে দিলেন৷ এরপরেও অনেক খোঁজ করা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত দুটি কক্ষ বিশিষ্ট একটি টালির বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল৷
গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রা নিয়ে পঠন-পাঠনের কাজ শুরু হল৷ প্রথম শিক্ষিকা-শ্রীমতী সুমিতা রায়৷ তাঁর বোনও পরবর্তীকালে ওই স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন৷ উক্ত বাড়িতে বছর খানেক স্কুল চলার পর ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও স্থানাভাব দেখা দেওয়ায় কাছাকাছি শ্রী শশাঙ্ক মাইতির বাড়ির দোতলায় স্কুলটি স্থানান্তরিত হল৷ ওখানে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো৷ ইতোমধ্যে সংস্থার পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ের উপযোগী জমির সন্ধান করা শুরু হয়েছে৷ সুরানানকার গ্রাম নিবাসী শ্রী সুধাংশু সাউ মহাশয় তখন মেদিনীপুরে চাকরীসূত্রে বসবাস করতেন৷ তিনি ও তাঁর বন্ধু মিলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে আনন্দমার্গ স্কুলের জন্যে তিন ডেসিমেল জায়গার ব্যবস্থা করলেন৷ সংঘটন থেকে সেই মূূহুর্তে অবধূতিকা আনন্দ বিশ্বমিত্রা আচার্যাকে স্কুলের প্রিন্সিপাল করে পাঠানো হয়েছে৷ এবার শুরু হল বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পর্ব৷ বিশ্বমিত্রা দি স্থানীয় সব মার্গীদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকলেন৷ বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে প্রত্যেকের মতামত নিলেন৷ আনন্দমার্গ স্কুলের নিজস্ব একটা বাড়ি একান্তই প্রয়োজন---এব্যাপারে সবাই একমত হলেন৷ একটা বাড়ি তৈরী করতে অনেক টাকা পয়সা লাগবে, কিভাবে তা সম্ভব হবে সে ব্যাপারে কেউ পথ নির্দেশ করতে পারলেন না৷ দিদি সবাইকে বললেন ---বাবা আমাদেরকে শিখিয়েছেন, কোন শুভ কাজে অর্থ কখনো বাধা হতে পারে না, চাই শুধু শুভ উদ্যোগ৷ ৰাৰার শেখানো পথে তিনি হাঁটবেন জানালেন৷ এব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করলেন ও জানালেন ---তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে বিশ্বমানবের কল্যাণার্থে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছেন৷ নিজের খাওয়া-পরা-থাকার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা তার আছে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁকে যদি খাওয়া পরার কথা চিন্তা করতে হয় তাহলে বাড়ি তৈরীর কাজে যথেষ্ট সময় ও শ্রম দিতে পারবেন না৷ যতদিন বাড়ি তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ না হচ্ছে ততদিন মার্গী দাদা দিদিদের এই বিষয় ভাবতে হবে৷ মার্গীরা এককথায় রাজি হলেন৷ দিদির জন্যে চাল-ডাল-সবজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কোথা থেকে কিভাবে আসবে, সে দায়িত্ব সবাই ভাগ করে নিলেন৷ হাতে এক পয়সা পুঁজি না নিয়েও জন সাধারণের দানে কোন বিদ্যালয় গৃহ হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা কোন মার্গীরই ছিল না৷ দিদি স্থানীয় মার্গী ও দিদিমনিদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাওয়া শুরু করলেন৷ দিদিকে সহায়তা করার জন্যে সংঘটনের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে অবধূতিকা আনন্দ শোভা আচার্যকে পাঠানো হল৷ বাড়ির প্ল্যানিং-এর জন্য এলেন আচার্য পূর্ণানন্দ অবধূত৷ মার্গীদের মনোবল বেড়ে গেল৷ কারো কাছে কিছু চাওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে যে লজ্জা, সংকোচ ও ভয় ছিল তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকল৷ দেখতে দেখতে একতলা পাকা বাড়ি হয়ে গেল৷ কিভাবে শূন্য থেকে শুরু কোন কাজে পরিপূর্ণ সাফল্যলাভ করা যায় তা দাদা দিদিদের নিকট থেকেই আমরা শিখলাম৷ যাঁদের পরিশ্রম ও সাহচর্য মনে রাখার মতো তারা হলেন শ্রী পতিত পাবন মাইতি, শ্রী শিশির কুমার মাইতি (পুতুল) ও শ্রী অসিত কুমার পণ্ডিত৷ আমার সংসার ও শিক্ষকতার সময় বাঁচিয়ে যতটুকু পেরেছি সহযোগিতা করেছি৷ সুরানানকার ইয়ূনিট সেক্রেটারী শ্রীরাধেশ্যাম মণ্ডল চাকুরী সূত্রে বেশী সময় দিতে পারেননি, তবে সব সময় পাশে থেকে মনোবল যুগিয়েছেন৷ আজ সুরানানকার আনন্দমার্গ স্কুল ত্রিতল গৃহ বিশিষ্ট, ছাত্র সংখ্যা প্রায় দুই শত৷ যাঁদের সাহায্য সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি বর্তমান রূপ লাভ করেছে, তাঁদের কথা আমরা পাঁশকুড়া বাসী কখনও ভুলতে পারবো না৷
- Log in to post comments