পরিচয় ঃ ‘পপি’ নামে এক রকমের ছোট ফুলের গাছ ইয়ূরোপ থেকে এদেশে এসেছিল৷ এটি শীতকালের মরশুমী ফুল৷ ভারতে এখন শখের ফুল হিসেবে অনেকেই বাগানে চাষ করেন৷ ফুলের রঙ নানান ধরনের–লাল, শাদা, হলদে, বেগনে৷ এটি নির্দোষ বা নির্বিষ বর্গীয়৷ ফুল ঝরে যাবার পর এর গাছে যে বীজকোরক আসে সেটা ছোট ও লম্বাটে৷ তার গা চিরে দিলে যে রস বের হয় তা নির্দোষ৷ বীজকোরকে যে বীজ হয় তা কালচে রঙের৷ এই পপির যে প্রজাতিটি ওপিয়াম পপি নামে পরিচিত, তা কিন্তু ভারতে বিদেশ থেকে আসেনি৷ সেটা এদেশেরই ফুল৷ সাধারণ পপি ও ওপিয়াম–পপির মধ্যে তফাৎ হ’ল, সাধারণ পপির চেয়ে এর পাতা বড়, মোটা, পুষ্ট ও সতেজ ও একটু বেশী রকমের জোরালো সবুজ৷ সাধারণতঃ এর ফুল ঘি–রঙের, দেখতে সাধারণ পপির ফুলের মতই–তবে একটু বড়৷ ব্রিটেনে দেখেছি, কোন কোন চাষী শখ করে গমের ক্ষেতের ভেতরে কিছু সাধারণ পপির বীজও ছিটিয়ে দেন৷ ফুল ফুটলে ভারী সুন্দর দেখায়৷ সেগুলির কেউই ওপিয়াম–পপি নয়৷ ভারতেও বাগানে কেউ ওপিয়াম–পপি লাগান না৷ লাগানো আইনতঃ নিষিদ্ধ, কারণ ওপিয়াম–পপির চাষ কেন্দ্রীয় সরকারের আবঁগারী বিভাগ কর্ত্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে৷
পোস্ত সাত্ত্বিক–পোস্তর গুণাগুণ ঃ ওপিয়াম পপির বীজকোরক সাধারণ পপি থেকে বড় ও পুষ্ট৷ এর গা চিরে দিলে এর থেকে রস বা আঠা বেরোয়৷ তাই হ’ল কাঁচা আফিং৷ এই ওপিয়াম পপির বীজকোরকে যে বীজ থাকে তার রঙ ফিকে ঘি–রঙের, তাকে আমরা পোস্ত বলে থাকি৷ কী অদ্ভুত ব্যাপার, পোস্তর বীজকোরকের আঠা বড় রকমের নেশা ও অধিক মাত্রায় সেবন করলে বড় রকমের বিষ, অথচ ভেতরকার বীজ পোস্তর দানা, যা একটি সত্ত্বগুণসম্পন্ন বস্তু, তা শরীরের স্নিগ্ধতা বজায় রাখতে সাহায্য করে৷
তরল ভেদ–বমিতে ও উদরাময়ের বাড়াবাড়ি অবস্থায় গরম ভাতে অল্প পরিমাণ কাঁচা পোস্ত বাটা ঈষৎ লবণ সহযোগে ভক্ষণ করলে দ্রুত রোগ অপসারণে সাহায্য করে৷ বাংলার মানুষ (বিশেষ করে রাঢ়ের মানুষ) পোস্তর বড়া তো খায়–ই, আলু–পোস্ত, ঝিঙ্গে–পোস্ত, বড়ি–পোস্ত, কুঁদরী–পোস্ত, কাঁচা পোস্ত–বাটা–সবই সাগ্রহে খেয়ে থাকে৷ কথায় বলে ‘‘অতি সর্বত্র বর্জয়েৎ’’৷ খুব বেশী পোস্ত খেলে অপাক আমাশয় হতে পারে৷ তবে মাঝারী পরিমাণ পোস্ত খেলে তা স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য দু’য়ের বৃদ্ধিতেই সাহায্য করে৷
পোস্ত শরীরকে পোষণ করে বলে সংস্কৃতে এর একটি নাম পোষিত (পোষিত> পোষ্ত>পোস্ত–‘ষ’ মূর্দ্ধ বর্ণ৷ তার সঙ্গে দন্ত্য বর্ণ ‘ত’ এর সংযুক্তি হয় না৷ তাই ‘পোস্ত’ বানানে ‘ষ’এর স্থানে ‘স’এর আগম হচ্ছে)৷
পোস্ত ও রাঢ়বাসী ঃ আফিং গাছের বীজকোরকের দানা (পোস্ত) একটি সাত্ত্বিক খাদ্য৷ এর পৌষ্টিক গুণ ও তৎসৎ ঔষধীয় গুণও রয়েছে৷ বাংলার, বিশেষ করে রাঢ়ের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য হচ্ছে–এই পোস্ত৷ রাঢ় একটি দরিদ্রভূমি–অন্ততঃ বর্ত্তমান সমাজ–ব্যবস্থায়৷ রাঢ়ে আফিং চাষ করতে দেওয়া হয় না৷ তাই রাঢ়বাসী তাদের প্রিয় খাদ্য ক্রয়ের জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা তো বটেই, এমনকি কোটি কোটি টাকাও ব্যয় করে বাইরে থেকে এই পোস্ত কেনবার জন্যে৷ গত ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৪ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার (economic depression) সময়েও
মানভূম জেলার চাণ্ডিলের গ্রামাঞ্চলে দেখেছি গরীব মজুর শ্রেণীর মানুষও পাঁচটি পয়সা নিয়ে বেণের দোকানে (লটকনের দোকান) গিয়ে কিনত ১ পয়সার চাল, ১ পয়সার ডাল, ১ পয়সার সরষের তেল, ১ পয়সার হলুদ তথা মশলা, ও ১ পয়সার পোস্ত৷ আজ এক পয়সায় পোস্তর একটা দানাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ৷ পোস্ত অর্থাৎ আফিমের চাষ কেন্দ্রীয় আবঁগারী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে হয়ে থাকে৷ তা হোক, এটা বাঞ্ছনীয়ও৷ তবে আবঁগারী বিভাগের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে রাঢ়ে প্রয়োজন মত পোস্ত পাওয়ার জন্যে যে পরিমাণ আফিম চাষের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ আফিম চাষের অনুমতি দেওয়া উচিত৷ অন্যথায় এই পোস্ত কিনতে গরীব রাঢ়ের অর্থের বহিঃস্রোত ক্ষন্ধ করা যাবে না৷ হ্যাঁ, একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, গরীব রাঢ়বাসী যাতে আফিংয়ে আসক্ত না হয় সেইজন্যে এই চাষের ওপর কড়া সরকারী তদারকী থাকা দরকার৷
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)