প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ–সমাজে নারীর স্থান ছিল অন্যান্য যে কোন জীবের স্বাধীন নারীর মতই৷ পুরুষেরা যেমন প্রকৃতির কোলে নেচে গেয়ে হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দিত নারীরাও তা–ই করত৷ এই অবস্থা চলেছিল যখন মানুষ সমাজ বলতে কোন কিছুই গড়েনি তখন তো বটেই, তার পরেও মাতৃশাসনের যুগেও৷ কিন্তু যখনই পিতৃশাসিত সমাজ ব্যবস্থা এল তখনই নারীর অধিকার ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করা হতে থাকল৷ গোড়ার দিকে ঠিক করা হ’ল মেয়েরা ততটুকু স্বাধীনতা ভোগ করবে যতটুকু বিবাহের পরে তার শ্বশুরকুল তাকে ভোগ করতে দেবে বা বিবাহের পূর্বে পিতৃকুল তাকে যে সুযোগটুকু দেবে৷
তার পরবর্ত্তীকালে অধিকারকে আরও সঙ্কুচিত করে দেওয়া হ’ল পনের বৎসর পর্যন্ত, অর্থাৎ ষোল–তে পদার্পণ করার পূর্ব পর্যন্ত নারীরা এই সুযোগ পাবে৷ তারপরে নিয়ম করা হ’ল পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এই সুযোগ পাবে৷ পাঁচের কোঠায় পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে এই সুযোগ আর থাকবে না৷ এই ধরনের নারী নির্যাতনের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল এই যে নারী প্রতি পদবিক্ষেপে অনুভব করুক তার পরাধীনতা.....সে বুঝুক, গৃহে, সংসারে, রাষ্ট্রে, সমাজজীবনে সর্বক্ষেত্রে সে পুরুষের অনুগৃহীতা৷
পৌরাণিক সমাজ তো আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বললে, নারী মুক্তি বা মোক্ষ পাবে না৷ জন্ম–জন্মান্তরের তপস্যায় সে যদি পুরুষ দেহ লাভ করে তবেই সে মুক্তি–মোক্ষের অধিকারিণী হবে৷ যতক্ষণ সে নারী ততক্ষণ তার কাছে পতি সেবাই পরম সেবা৷ সেই যে সিঁদুর–মাখানো কাঠের কৌটোয় কাশীর বাজারে নিশ্চয়ই দেখেছ বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে ‘‘পতি পরম গুরু, পতি সেবাই পরম সেবা’’ অথবা ‘‘পতি যার ধ্যান–জ্ঞান, পতি হেন দেবতা/স্বর্গ হতে শ্রেষ্ঠ পতি, পতি ভাগ্য বিধাতা’’৷
ক্ষমতালোভী অবিবেচক কিছু সংখ্যক মানুষ এই সব মতবাদ প্রচার করে নারীকে আচ্ছন্নবুদ্ধি ও পুরুষকে মদগর্বী করে তুলেছিল৷ এই ব্যবস্থা যে প্রকৃতিবিরোধী তা মুক্তাঙ্গনের চারিপাশে তাকালেই বোঝা যায়৷ কেউ কি বাঘিনীকে বোরখা পরিয়ে রাখতে পারে৷ সে মুরোদ কারোর আছে কেউ কি বাঘিনীকে বলতে পারে, তুই লাফ দিয়ে খাল পার হবি না, বা ওই যে খেলাধূলা, ওই যে স্পোর্টস্, নারী ও সব করতে পারবে না৷ হ্যাঁ, ওই মানুষগুলো শুধু যে অবিবেচক ছিল তাই–ই নয়, তাদের যুক্তির ত্রুটি–বিচ্যুতি সম্বন্ধেও সম্যক রূপে অবহিত ছিল৷ তাই তারা ওই সকল অর্থহীন কথা সোজাসুজি নিজেদের দায়িত্বে প্রচার না করে ঈশ্বরের নাম ভাঙ্গিয়ে বলেছিল, এটা ঈশ্বরের বাণী, এর ওপরে কথা বলা চলবে না....রা–টি কাড়া চলবে না৷
মেয়েদের মধ্যেও যেদিন আত্মশ্লাঘা জাগবে তারাও সেদিন এই দাসীত্বের বোরখা–ঘোমটা ছিঁড়ে ফেলে অন্যান্য প্রাণদীপ্ত জীবের মতই সংযত ও সংহত ভাবে সমাজ সেবায় তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে৷
ক) গোষ্ঠীমাতা
মানুষের সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সামাজিক সমস্যাও তাদের সামনে দেখা দিয়েছিল৷ প্রথম ও প্রধান সমস্যাটি ছিল বিভিন্ন পর্বতে ও জনপদে বসবাসকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মধ্যেকার সংঘর্ষ৷ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে গোড়ার দিকে পর্বত কন্দরে বাস করত৷
অগ্ণি আবিষ্কৃত হবার পূর্ব পর্যন্ত তারা রাত্রে ভয়ে গুহার মধ্যে কাল কাটাত ও অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে গুহায় প্রবেশ করত ও একটা বড় পাথর এনে গুহার মুখ বন্ধ করে দিত৷ মানুষ তখন ছিল বড়ই অসহায়৷ তাদের গায়ের জোর ছিল অনেক জীবের চেয়ে কম৷ মস্তিষ্কের জোর অনেক জীবের চেয়ে বেশী হলেও তা আজকের তুলনায় ছিল অকিঞ্চিৎকর৷ অন্য জীবের মত নখের দাঁতের জোরও তার ছিল না৷ জলের প্রয়োজন থাকায় পাহাড়ী ঝর্ণার কাছেই তারা বেশী থাকত৷ আর ঝর্ণার কাছে সব সময় তো গুহা পাওয়া যায় না৷ সমতলে নদীতীর থাকলে জলের সমস্যা থাকে না৷ কিন্তু রাত্রিতে সেখানে নিরাপত্তা অত্যন্ত কম৷ তাই মানুষকে অবস্থার চাপে সমতলে বা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্ত্তী উপত্যকা বা অধিত্যকায় ধীরে ধীরে সরে আসতে হ’ল৷ সেখানে তারা পাখীর দেখাদেখি গাছের ওপর বাসা বাঁধতে শুরু করলে লতাপাতা ডালপালা দিয়ে৷ হয়তো এটাই ছিল মানুষের সভ্যতার পথে প্রথম পদক্ষেপ৷
গুহার দখল নিয়ে, গাছের দখল নিয়ে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দাঙ্গা–হাঙ্গামা বাঁধত৷ লড়াইয়ের ধরন–ধারণও ছিল প্রাগৈতিহাসিক ধরণের–নখে দাঁতে৷ প্রাচীন ব্রিটেনের সঙ্গে প্রাচীন আইবেরিয়ার যে সন্ধি হয়েছিল তাতেও উল্লেখ ছিল তারা একে অন্যকে বিপদে–আপদে নখে–দাঁতে ঢিলে–পাটকেলে সাহায্য করবে৷
সে যুগে মানুষের তাই সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজন প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছিল৷ সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে সব গোষ্ঠী নিজেদের দলে নারীর সংখ্যা বাড়াতে চাইত৷ প্রতিটি গোষ্ঠীতে মউমাছি বা পিঁপড়েদের মত একটি করে কেন্দ্রগতা নারীশক্তি থাকত যাকে বলা হত গোষ্ঠীমাতা৷
তারা নারীর সংখ্যা বাড়াতে চাইত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে৷ এক পুরুষের দশটি স্ত্রী থাকলে এক বছরে তার দশটি সন্তান হতে পারে কিন্তু এক নারীর দশটি স্বামী থাকলেও এক বৎসরে একটি সন্তানই হতে পারে৷ তাই একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করে পরাজিত গোষ্ঠীর নারীকে তারা অপহরণ করে আনত৷ আর পুরুষদের ক্রীতদাস করে রাখত৷ সে যুগে সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে সেই অনগ্রসর মানুষ লিঙ্গ পূজার হ্মড়্ত্রপ্তপ্তন্ন্তু ভ্রপ্সব্জব্দড়ন্হ্মগ্গ্ প্রবর্ত্তন করেছিল..... ভেবেছিল এতে বুঝি তাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে৷
যাইহোক, পরবর্ত্তীকালে নারী লুঠেরাদের সম্পত্তি বলে গণ্য হত বটে কিন্তু, গোষ্ঠীপতি হিসেবে তারা আর নারীকে না রেখে বীরত্বে ভাস্বর শৌর্যসম্পন্ন আদেশদাতা ও দক্ষযোদ্ধা পুরুষকে তাদের নেতৃত্ব পদে বরণ করে নিয়েছিল৷ থাকত তাদের উপদেষ্টামণ্ডলী–এটাই ছিল রাজতন্ত্রের প্রথম ধাপ৷