প্রাউটের দৃষ্টিকোন থেকে বাঙলায় শোষণের স্বরূপ

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

ঔপনিবেশিক শোষণ

ৰাঙলার ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগটা ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের যুগ৷ ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ৰাঙলায় বিশাল অর্থনৈতিক বাজারটা দখল করার জন্যে সুপরিকল্পিতভাবে ৰাঙলার শিল্পগুলিকে ধ্বংস করে দিল, আর ৰাঙালী শিল্পী ও কারিগরদের ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের নির্মিত কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করল৷ যারা বাড়িতে বসে কাজ করত, ব্রিটিশ পুঁজিপতি পরিচালিত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের থেকে অঙ্গীকার আদায় করে নিত যে কারিগররা একমাত্র কোম্পানীর কাছ থেকেই কাঁচামাল কিনবে আর সেই কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত পণ্য তারা কোম্পানীর কাছেই বিক্রী করৰে৷ ব্রিটিশ কোম্পানী কাঁচামাল সংগ্রহ করত লুণ্ঠন করে ও জোর জুলুম করে৷ কারিগরদের কাছে ওই কাঁচামাল তারা বেশী দামে বিক্রী করত আবার কারিগরদের কাছ থেকে কেনার সময় তারা প্রকৃত  মূল্যের এক এক চতুর্থাংশ দামে জোর করে নিয়ে নিত৷ আর কোম্পানী সেগুলি বিক্রয় করার সময়ে প্রকৃত মূল্যের অধিক নিত৷ যেসব কারিগর এই শঠতায় আসতে চাইত না তাদের কোমরে দড়ি দিয়ে প্রকাশ্যে চাবুক মারা হত৷ ৰাঙলার তাঁতীরা ভবিষ্যতে কোনোদিন যাতে ম্যাঞ্চেষ্টারে উৎপন্ন শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারে তার জন্যে তাঁতীদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে তাদের শিল্প নৈপুণ্যকে চিরকালের জন্যে ধ্বংস করে দেওয়া হ’ল৷ এইভাবে তারা পলাশীর যুদ্ধের পর মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ৰাঙলার রেশম, সুতি, চীনী, লবণ, লোহা, রঙ, যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি সবকিছুকে ধ্বংস করে দিল৷ যে সমস্ত অসংখ্য কারিগর বংশ পরাম্পরায় বিভিন্ন শিল্পে নিযুক্ত ছিল, তাদের নিজস্ব রুজিরোজগারের স্বাভাবিক পথ থেকে উৎখাত করে সকলকেই কৃষির দিকে ঠেলে দেওয়া হ’ল৷ নীট ফল ছিয়াত্তরের ভয়াবহ মন্বন্তর৷ এইভাবে ৰাঙলা হ’ল প্রধানতঃ কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ ও ইংল্যাণ্ডের উৎপন্ন দ্রব্য খালাসের এক বিশাল বাজার৷ একেই বলে ঔপনিবেশিক শোষণ৷

স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৩৪ বছর পরেও ৰাঙলা ও পৃথিবীর বুক থেকে ঔপনিবেশিক শোষণ মুছে যায় নি৷ বরং ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারা এই শোষণ আরও গভীর ও ব্যাপক হয়ে উঠেছে৷ বর্তমানে ভারতীয় পুঁজিপতিরা পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ণ এলাকাগুলিকে কাঁচামাল সরবরাহের উৎস বলে গ্রহণ করেছে৷ এই সমগ্র অঞ্চল থেকে ৰাঙলার খনিজ, কৃষিজ ও বনজ সম্পদগুলি ন্যায্য দামের অনেক কম মূল্যে পুঁজিপতিরা সংগ্রহ করে নেয় ও গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাৰ, রাজস্থান ইত্যাদি নিজস্ব অঞ্চলের কারখানা থেকে সেগুলিকে পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত করে, পুনরায় তা দ্বিগুণ মূল্যে ৰাঙলার বাজারে বিক্রয় করে৷ বর্তমানে ৰাঙালীর উদয়াস্ত জীবনযাত্রার প্রতিটি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যই বাইরে থেকে উৎপাদিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে আসে, অথচ সবগুলির উপকরণ ও কাঁচামাল জোগায় পশ্চিমবঙ্গ৷ ঠিক এই ব্যবস্থার পাশেই পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব শিল্পগুলিকে ধ্বংসপ্রায় ও পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে যাতে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত পণ্য কোনোক্রমেই ভারতীয় পুঁজিপতিদের নিজস্ব অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারে৷ পঞ্জাব ও হরিয়ানাকে চর্মশিল্পের একচেটিয়া কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করা হয়েছে৷ কিন্তু ওই দু’টি রাজ্যে পশুচর্ম মোটেই লভ্য নয়৷ তরাই, ডুয়ার্স ও সুন্দরবনের গভীর অঞ্চল থেকে কাঁচামাল হিসেবে পশুচর্ম সংগ্রহ করে তা থেকে নিজস্ব কারখানায় খেলার উপকরণ ও চর্মশিল্পের দ্রব্য উৎপন্ন করে, তা সমস্তই পশ্চিমবঙ্গের বাজারে আনীত হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব বাজারে কাট্তির জন্যে কোনো চর্মশিল্প কেন্দ্র নেই৷ বাটানগরে উৎপাদিত জুতার কিয়দংশ পশ্চিমবঙ্গে রেখে সবটাই বৈদেশিক বাজারে রপ্তানি করা হয়৷ খেলাধুলার সরঞ্জাম তৈরীর ক্ষেত্রে একই অবস্থা৷ পশ্চিমবঙ্গ এদের কাছে কাঁচামাল সরবরাহকারী ‘পরদেশ’ ও তাদের নিজস্ব অঞ্চলের উৎপাদিত সামগ্রীর খালাসের এক বিশাল বাজার৷ ওইসব ভারতীয় ঔপনিবেশিক শোষকদের জৈবিক মনস্বত্ত্ব হ’ল, ‘পরদেশ মে আয়া হ্যায়, যিত্না হো শকে লুঠ্লো৷’ বলাবাহুল্য ঔপনিবেশিক শোষণের সবটাই অর্থনৈতিক শোষণ৷